গ্রেটার নয়ডা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কর্পোরেট পরিকল্পিত
শহর। মানুষ সেখানে রাস্তায় হাঁটে না। রাস্তাগুলি অশ্লীল রকম চওড়া। রাস্তার ধারে
আরও একটা রাস্তা। নাম সার্ভিস রোড। প্রত্যেকটা রাস্তা আরও একটি রাস্তাকে কেটেছে
উল্লম্বভাবে। রাস্তায় বাঁক খুব কম, যাতে সাঁজোয়া বাহিনী বিনা বাধায় চলাচল করতে
পারে। অনেক দূর পর্যন্ত খালি চোখে নজরদারি করা যায়। কোনও আক্রমণকারী সহজে আক্রমণ
করে পালিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য রাস্তা আর রাস্তার পাশগুলি কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা।
পশ্চিমের শহর পরিকল্পনায়, প্রতিবাদীদের সহজে গুলি করে বা মারণ হাউই চালিয়ে মেরে
ফেলা যায়। মলের বাইরে অন্য দোকান প্রায় নেই। হকারদের সঙ্গে লাল আলোজ্বালা পুলিশের
গাড়ি হকার পুলিশ খেলা খেলে। শেষ পর্যন্ত জয় অদম্য হকারদের হয়। এই শহরের অপচয়তম
গাড়ি দৌড়ের মাঠের নাম গৌতম বুদ্ধ। জেলাটির নাম গৌতম বুদ্ধ নগর।
এমত এক ‘পরিকল্পিত আধুনিকতম’ বৌদ্ধিক শহরে বাঙ্গালীদের
দুর্গোপুজোয় আমাদের সংগঠনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। মেলার মাঠে বাঙ্গালিরা
দলবেঁধে আসছেন। অথচ অবাঙ্গালীরাই মুলতঃ ক্রেতা। বাঙ্গালীদের দেখে মনেহয় বেশ
উচ্চমধ্যবিত্ত। গায়ে মহার্ঘ্য পরিধেয়। বাহনও বেশ খরুচে। সে শহরে সময় কাটাতে তাদের
যেতে হয় শপিং মলে। অন্য কোনও সংস্কৃতিকর্ম যে নেই। ফলে তারা যে অর্থ খরচ করেন না
তাও নয়। সেখানে গেলেতো কেনাকেটা করতে হয়। ছোট একটি শপিং মলের বাইরের সাজানো গোজানো
একটি দোকানে মেসিনের চা ১৫ টাকা, এক রত্তি পান ১৫ টাকা। পাই ১ আর ২ সেক্টরের
রাস্তার ধারের ব্যতিক্রমী কাঁচা তরকারির দোকানে আলু ৪০ থেকে ৬০ টাকা। পেঁয়াজ ৬০
১০০ টাকা। প্রায় প্রত্যেকের হাতে দামি ২০,০০০+ মোবাইল।
প্রত্যেক বাঙ্গালি
মাঠে ঢুকলেই কেমন পাল্টে যাচ্ছেন। যে ১২টা দোকান হয়েছিল তাতে স্থানীয়ভাবে পাওয়া
যায় এমন প্রায় কিছুই ছিল না। প্রত্যেকটা শিল্পের বাংলায় জন্ম, এমন এক অদৃশ্য ছাপ
বহন করছিল। দু একজন বাদ দিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই সাধারন সব দ্রব্যের তৈরির উপাদান
জিগ্যেস করছিলেন। অনেকেই পাট, বাঁশ, পোড়ামাটি বা মোষের শিং চিনতে পারছিলেন না।
চিনিয়ে দিলেও মুখ বেঁকিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। এক মহিলা জিগ্যেস করলেন পোড়ামাটির
গয়নায় জল পড়লে গলে যাবে না তো! এক বাঙালি উত্তরপ্রদেশের গরমে কোট টাই পরে, ১৫০
টাকার পাটের জুতো ৫০ টাকায় কিনতে চাইলেন। বললেন পাটের দাম তিনি জানেন, তাই এর বেশী
দেওয়া যায় না। তার হাতে ধরা স্যামসঙ্গের ৩০ হাজারি+ ট্যাবলেট। বাধ্য হয়ে বলাগেল এই
মোবাইলটি কেনার সময় তিনি দর দাম করতে পেরে ছিলেন কিনা? এটির মূল দাম কত কে বলে
দেবে? যখন শপিং মলের মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যান তার টিকিট কেনার সময় দরাদরি
করতে পারেন কিনা? সরকারি রান্নার গ্যাস গাড়ির তেল কেনার সময় দরাদরি করা যায় কিনা?
বিমানের টিকিট কাটতে দরাদরি করা যায় কি না? উনি শেষমেশ আমাদের মুর্খ দেগে এগিয়ে গেলেন
পুজো মন্ডপে দেবীর পায়ে প্রণতি জানাতে। পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত এক বাঙালি মোষের
শিঙের নানান দ্রব্য হাতে তুলে দেখছিলেন। দাম শুনে কপাল কুঁচকলেন। বললেন এর
ইউটিলিটি কি? কেন এটি কিনব? বাড়িতে স্টিলের তৈজসপত্র রয়েছে। মোষের শিঙের জিনিস
কেন? সেই কোনকালে রামমোহন এ দেশে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন উপযোগিতাবাদ। তার রেশ যে
এই ব্যক্তিটি ঘরে রেখেছেন, সেই তথ্য চোখের সামনে দেখে বেশ পুলকিত হচ্ছিলাম।
No comments:
Post a Comment