অঞ্জন সেন
প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল বুকপকেট নামক একটি অন্তর্জাল পত্রিকায়। লিঙ্কটি হলhttp://bookpocket.net/archives/lekha/kalighat-pot
অজিত ঘোষ, বীরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়, গুরুসদয় দত্ত, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভোলানাথ ভট্টাচার্য প্রমুখরা কালীঘাটের পটের সম্পর্কে অনেক তথ্য রেখে গেছেন, কিন্তু কোনও বাঙালি শিল্প ঐতিহাসিক কলাসমালোচক কালীঘাটের পট নিয়ে দীর্ঘ
গবেষণামূলক কাজ করেননি যা করেছেন শ্রী জয়তীন্দ্র জৈন। আর্চার ছাড়া চেক গবেষিকা Hana Kinzkova-র ‘দি ড্রইংস অফ দি কালীঘাট স্টাইল,’ প্রাগ, ১৯৭৫ বইটিও উল্লেখযোগ্য।
কালীঘাট পটুয়া পরিবারের মেয়েরা ছবি আঁকতেন না, তাঁরা পুরুষদের ছবি আঁকার কাজে সহযোগিতা করতেন। যেমন
রঙ গোলা, তুলি তৈরি রাখা
ইত্যাদি। এঁরা পুতুল তৈরি করতেন। আগেই বলা হয়েছে নানান জাতির শিল্পীরা কালীঘাট পট
আঁকতেন – কুম্ভকার, সূত্রধর, সদগোপ। পরবর্তীকালে একই
পটচিত্রের কপি হয়েছে একাধিক। যামিনী রায়ের ছবির মতো। শুধু দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ নয়, পূর্ববঙ্গ থেকেও শিল্পীরা
এসেছেন। ঢাকার পটুয়াটুলি অঞ্চলের বাসিন্দা গণেশ পালের দুই ছেলে শশধর ও হলধর, কালীঘাটে এসে রজনীকান্ত পটুয়ার
কাছে পট আঁকা শেখেন। কালীঘাটের পটশিল্পের অন্তিম পর্যায় ১৯৩০ সাল পর্যন্ত শশধরের
পট আঁকার খবর পাওয়া গেছে শ্রী পরিমল রায়ের কাছে।
পটুয়াদের
সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না, বিশেষ করে প্রথম দিকের পটুয়াদের সম্পর্কে। তবে
নীলমণি দাস,
বলরাম দাস, গোপাল দাস এঁদের নাম জানা যায় (১৮৯২-১৯৬৬)।
পরবর্তী কালের পটুয়া রজনী চিত্রকর, খুবই সংক্ষিপ্ত একটি জীবনী লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর
জন্ম মেদিনীপুরের আকুবপুর গ্রামে এক কুমোর পরিবারে। ‘আমরা পুরুষানুক্রমে ছবি আঁকা প্রতিমা
নির্মাণ,
পটচিত্র লেখা প্রভৃতি যাবতীয় বৃত্তি
অবলম্বন করিয়া পূর্বপুরুষের ভিটা আকুবপুর গ্রামে আজ প্রায় দুইশত বৎসর বসবাস
করিতেছি’
(রজনী চিত্রকর, অন্বিষ্ট-পট সংখ্যা)। এ থেকে দেখা যায়
কুমোর বা মৃৎশিল্পীরা পুরুষানুক্রমে ছবি বা পট আঁকতেন। রজনী চিত্রকর, বলরাম ঘোষ, নিবারণ দাস প্রমুখ প্রখ্যাত পটুয়াদের
কাছে পট আঁকা শিখেছেন আবার ‘প্রখ্যাত
শিল্পী চিন্ময়ীলাল চিত্রকরের সহকর্মীরূপে বেহালার সাধন চৌধুরীদের রথে আন্দুল মৌড়ীর
জমিদারদের রথে ছবি লিখিয়া প্রশংসা অর্জন’ করার কথা বলেছেন, ময়ূরভঞ্জের মণ্ডপ সজ্জা, প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুরের বাগানবাড়ি ‘চিত্রপুরী’র কুঠিতে বহুদিন চিত্রাঙ্কন ও প্রতিমা
নির্মাণ করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ শুধুমাত্র পট এঁকে এঁদের জীবিকা নির্বাহ হত না, এর আগেকার কালীঘাটের পটুয়াদের
ক্ষেত্রেও এইরকম বিবিধ শিল্পকর্ম করে থাকা সম্ভব।
এ দেশের চিত্রকলায় কালীঘাটের পটুয়ারাই প্রথম
নাগরিক জীবনযাপন তুলে আনলেন। আগে জাতপটুয়াদের পটে, পুথিচিত্রে, বিষ্ণুপুরি চৌকা পটে, দেবদেবী, পৌরাণিক
উপাখ্যান, জাদু ও লোকায়ত কিছু বিশ্বাস দেখা গেছে, নাগরিক জীবন বা দৈনন্দিন জীবনের চিত্র নেই। অবশ্য
মন্দির গাত্রের টেরাকোটায় কিছু কিছু সমকালীন বিষয় – যেমন
সাহেব বিবি, নানান
নৌকা ইত্যাদি দেখা গেছে। উনিশ শতকের গোড়ায় কলকাতা শহরে দ্রুত নগরায়ণ শুরু হল, বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে বসতি স্থাপন করল, এলেন ভিন্ন প্রদেশের লোক ও প্রচুর ইওরোপীয়। এরই
অভিঘাত পড়ল কালীঘাটের পটে। বাংলার ব্যঙ্গ চিত্রের সূচনাও কালীঘাটের পটে – বাবু কর্তৃক বিবির পদ সেবা, ভণ্ড বৈষ্ণবের মাথায় একটা পাখি – এরকম অনেকগুলি ছবি দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ছবিতে
রয়েছে ‘বাবু কালচার’কে
বিদ্রূপ করার লক্ষণ।
No comments:
Post a Comment