সোনাধরের নাম শুনছি সেই নতুন ধরণের শেখার প্রথমকাল থেকে।
সেই পাল্টে দেওয়ার সময়টিতে আমারই দেশের নতুন এক পৃথিবীকে জানার জন্য গোগ্রাসে অনেক
বই পড়ছিলাম যা আমাদের আয়ত্বের মধ্যে ছিল না এতকাল। তার মধ্যে একটি মীরা
মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বকর্মার সন্ধানে। অসম্ভব শ্রদ্ধায় তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন,
বিশ্বকর্মা সোনাধর এবং তাঁর বাবাকে। এঁদের সঙ্গে নিয়ে, এঁদের প্রযুক্তি শিখে তিনি
সৃষ্টি করে চলেছিলেন একের পর এক পথ ভাঙা নির্মান শৈলী। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম
না। কিন্তু তিনি এবং গ্রাম-শহরের এরকম অনেক চেতনগুরু, দৃষ্টিহীন, অজ্ঞান, অশিক্ষিত
আমাদের হাত ধরে মায়ের মমতার শিখিয়ে দিচ্ছিলেন দেশ চেনা, জানার চিরপরিচিত কিন্তু
অজানা পথটি। বলতে শিখলাম, এদের সঙ্গে থেকে মীরাদি কাজ শিখেছিলেন। বুঝলাম মীরাদিও
সেটিই বলতে চেয়েছেন তাঁর বইতে। তাঁদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে অবলীলায় বলতাম
সোনাধরেরা, প্রখ্যাত ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন।
সেই অসম্ভব এক প্রযুক্তির ধারক-বাহক কলকাতায় এসেছেন, অথচ
ভারতে কলাকৃতির একনম্বর শহর, বুকফোলানো কলকাতায় তার উপস্থিতির স্বীকৃতি নেই। আমাদেরই দলের
বন্ধু মার্ফত সংবাদ পেয়েতো দৌড়ে গেলাম মেলা প্রাঙ্গণ। বুঝলাম
উদ্যোক্তারাও জানেন না সোনাধরের
ইতিহাস। নামও বোধহয় শোনেন নি। বিশ্ব প্রযুক্তির ইতিহাসে তাঁর বা তাঁর সম্প্রদায়
কতটা গুরুত্বপুর্ন অবদান পেশ করেছেন, সেটিও বোধহয় জানেন না। অথচ মেলাটির
প্রধান পরিচালক এমন একজন শিল্পী, যিনি কলকাতার একটি শিল্প মহাবিদ্যালয়ের গর্বিত
সংশাপত্রধারী। গ্রামীণ শিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত অন্যধরনের দুর্গোপুজোর মণ্ডপ বানিয়ে
থাকেন। ভারতীয় শিল্পের অন্যতম কর্নধার তিনি। বাস্তব হল সোনাধরকে
তারা চিনতেই পারেন নি। পরে মেলায় সরকারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে শোনাগেল ভিন
রাজ্যের শিল্পীদের পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি মন্ত্রক। তাঁদেরই অনুরোধে
সোনাধর কলকাতায়। কেন সোনাধরের দোকান মেলার শেষেরদিকে এমন এক যায়গায়, যেখানে দর্শক সহজে
পৌঁছতে পারেন না, সেই উত্তর শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম তাঁদের সোনাধরের প্রতি
ব্যবহারে।
পৌছানো গেল তাঁর কাছে। আমরা উত্তেজিত। সোনাধরের গ্রামীণতায়
তাপ উত্তাপ নেই। দোকান সাজিয়ে বসে রয়েছেন এমন একজন ব্যক্তি, যার সম্প্রদায় ব্রিটিশ
ভারতে আসার কয়েক হাজার বছর আগে বিশ্বকে শিখিয়েছেন জং ছাড়া লোহা তৈরির সহজতম
পদ্ধতিটি। তিনি এবং তাঁর বাবা কাজ শিখিয়েছেন এমন এক পথ ভাঙা শিল্পীকে যার কাজ দেখে
আজও বিশ্বজোড়া শহুরে নবীন শিল্পীরা নিজেদের গড়েতোলার চেষ্টা করেন। তাঁর তৈরি শিল্পদ্রব্য(না
প্রযুক্তি) বিশ্বের নানান দেশের নামীসব শিল্প সংগ্রহশালায় গর্বিতভাবে তাঁর
সম্প্রদায়ের পরিচয় বাখান করছে। তিনি নিজের হাতে কিছুটা হলেও পালটে দিয়েছেন কয়েক
হাজার বছরের নিজেদের সম্প্রদায়ের শিল্পের ধারণা। সেই মানুষটি শীতের সন্ধ্যায় মেলার
জনমানবহীন এক কোণে চুপটি করে বসে রয়েছেন। মাথায় বাঁদুরে টুপি।
আমগ্রামীণ ভারতীয়র চেহারা যেমন হয় তেমনটিই তিনি। আমি সোনাধর বিশ্বকর্মা, সব্বার
থেকে আলাদা, সারা বিশ্ব একডাকে চেনে, এইরকম শহুরে উচ্চকিত ঘোষণা নেই তাঁর চেহারায়। যেন সব কিছু সরল
স্বাভাবিক গ্রামীণ দিনযাপনেরমত
নিরুচ্চার।
লোকজন না আসার সুবাদে সে সন্ধ্যায় সোনাধরের সঙ্গে
অনেক কথা হল। প্রায় ২০ বছর নতুন করে দেশ জানার, চেনার কাজে বুঝলাম, কিছুই জানি নি,
কিছুই শিখি নি। কি নম্র বাচন ভঙ্গী। কি অদ্ভুত প্রশান্তি তাঁর মুখমণ্ডলে। সেদিন
সোনাধর আমাদের অনেক কিছু না বলেও শিখিয়ে গেলেন বিরাট কিছু তত্ব, যা সেদিন সোনাধরের
সংগ না করলে বোধহয় বহুদিন অধরা থেকে যেত। আমাদের নিজেরও খুব অস্বস্তি করছে, এই
প্রবন্ধে, সহুরেদেরমত বারবার, প্রত্যেক পঙক্তিতে সোনাধরের নাম টেনে আনায়। শহুরে মধ্যবিত্তীয় ব্যক্তিপুজোর ঢঙে সোনাধর
বন্দনা কিছুটা কর্কশ ঠিকই। আমরা এই প্রবন্ধে সোনাধরকে সামনে রেখে বুঝতে চেষ্টা করব
ভারতীয় গ্রামীণ উৎপাদক সম্প্রদায়গুলোর দর্শণ, তত্ব আর তাঁদের কাজের পদ্ধতিটি।
No comments:
Post a Comment