দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন বিলেত যাচ্ছেন, তার আশংকা ছিল, তার উত্তরাধিকারীরা হয়ত শেষ
পর্যন্ত তার এই মহার্ঘ বেলগাছিয়া ভিলা রক্ষা করতে পারবেন না। অন্য রকম পত্রিকার
প্রথম বর্ষ, চতুর্দশ সংখ্যার ২৭ পাতায় ‘পিতামহ-পৌত্রের প্রথম সমুদ্রযাত্রা’
প্রবন্ধে অতনু বসু বলছেন, ‘রওনা হবার প্রাক্কালে দ্বারকানাথ বেলগাছিয়ায় সুবৃহৎ
ভিলা এবং তার অভ্যন্তরস্থ মুল্যবান সামগ্রী বিক্রির জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন
দিচ্ছেন।’ ইংলিশম্যান পত্রিকা লিখছে,‘যেসব মহামূল্যবান সামগ্রী এই একটি মনোরম
স্থানে – এই পরীদের রাজ্যে দ্বারকানাথ সমাহৃত করেছেন, সে সমস্তই কি বাকপটু
নীলামদারের হাতুড়ির ঘায়ে বিকিয়ে যাবে, সর্বচ্চ দাম যে হাঁকবে তার কাছে, জলের দরে?’
বাস্তব সম্পর্কে দারুন সচেতন দ্বারকানাথ যে খুব খারাপ
ভেবেছিলেন তা বলা যাবে না। পুত্রদের যে তাঁর সাম্রাজ্যের নানান কলকব্জায়
কর্পোরেটিয় তৈলমর্দন এবং লুঠের কাজে খুববেশী উৎসাহ ছিল, সে কথা বোধহয় দেবেন্দ্রনাথের
জীবনী পড়লে বোঝা যায় না- ‘আমাদের বাড়ীতে বিদ্যাবাগীশ সাহস করিয়া আমাকে পড়াইতে
পারিতেন না। যে হেতুক আমার পিতার একটি কথা শুনিয়া তিনি ভয় পাইয়াছিলেন। তিনি
বিদ্যাবাগীশের প্রতি এক দিন বিরক্ত হইয়া বলিলেন যে, ‘আমি ত বিদ্যাবাগীশকে ভাল
বলিয়া জানিতাম, কিন্তু এখন দেখি যে, তিনি দেবেন্দ্রের কাণে ব্রহ্মমন্ত্র দিয়া
তাঁহাকে খারাপ করিতেছেন। একে তাঁর বিষয়-বুদ্ধি অল্প – এখন সে ব্রহ্ম ব্রহ্ম করিয়া
আর বিষয় কর্ম্মে কিছুই মনোযোগ দেয় না।’ আমার পিতার বিরক্ত হইবারও একটা হেতু ছিল।
যখন এখানে গবর্ণর জেনারেলের ভগিনী মিস্ ইডেন প্রভৃতি অতি প্রধান প্রধান বিবি ও
সাহেবদিগের এক ভোজ হয়। রূপে, গুণে, পদে, সৌন্দর্য্যে, নৃত্যে, মদ্যে, আলোকে আলোকে
বাগান একেবারে ইন্দ্রপুরী হইয়া গিয়াছিল, এই ইংরাজদের মহা ভোজ দেখিয়া কোন কোন
বিখ্যাত বাঙ্গালীরা বলিয়াছিলেন যে, ‘ইনি কেবল সাহেবদের লইয়া আমোদ করেন,
বাঙ্গালীদের ডাকেন না।’ এই কথা আমার পিতার কর্ণগোচর হইল। অতয়েব ইহার পরে তিনি
একদিন ঐ বাগানে প্রধান প্রধান বাঙ্গালীদের লইয়া বাইনাচ ও গান বাজনা দিয়া একটা
জমকাল মজলিস্ করিলেন। সেদিন তাহাঁদিগকে অভ্যর্থনা ও পরিতোষণ করা আমার একটি
নিতান্ত কর্ত্তব্য কর্ম্ম ছিল; কিন্তু ঘটনাক্রমে সে দিন আমাদের তত্ববোধিণী সভার
অধিবেশনের দিন পড়িয়া গিয়াছিল। আমি সেই সভা লইয়া ব্যস্ত ও উতসাহী – আমরা সেই দিন
ঈশ্বরের উপাসনা করিব, অতয়েব এই গুরুতর কর্ত্তব্য ছাড়িয়া আমি আর বাগানের মজলিসে
যাইতে পারিলাম না। পিতার শাসনে ও ভয়ে একবার তাড়াতাড়ি করিয়া সেই বিলাস ভূমি ঘুরিয়া
চলিয়া আসিলাম। এই ঘটনাতে আমার মনের ঐ দাস্য তাঁহার নিকটে বিশেষ প্রকাশ হইয়া পড়িল(মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী)।’
পার্থিব সম্পদে সন্তানের প্রায়বৈরাগ্য দেখে, বেলগাছিয়া
ভিলার বিপুল মুল্যবান সামগ্রী নিলামে তুলে, অজস্র ঋণে জর্জরিত হয়ে লন্ডন থেকে ভারত
ফেরত হলেন। দ্বারকানাথ যেন মহাভারতের অর্জুন।
এককালে দেবতারা মধ্যম পাণ্ডবকে যে মহার্ঘসব শস্ত্র উপহার দিয়েছিল, শেষ জীবনে, একটি
একটি করে সেগুলি তারা ফেরত নিচ্ছেন। মূষলপর্বের শুরুতে অসহায় অর্জুন তাকিয়ে তাকিয়ে
দেখছেন, তাঁর মাথায় আর দেবতাদের অভয় হস্ত নেই। চির পরিচিত গাণ্ডীবও মহাভারি।
No comments:
Post a Comment