অথচ সোনাধরকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা নয় আমাদের। আমরা
বেড়ে উঠেছি এমন এক বামপন্থী পরিবারে, যারা সাম্প্রদায়িকভাবে তথাকথিত লোকসংস্কৃতি
বিষয় আলোচনায় লুপ্তপ্রায় শব্দটি বেশ কয়েকবার জোর দিয়ে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
এবং মনে করেন, মধ্যবত্তের বড় দায়, সেই দ’য়ে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে উদ্ধারের। এমনই এক পরিবারে জন্মেছি, যখন ছয়ের
দশকের শেষের দিকে যখন মায়ের পেটে হেঁটমুণ্ডউর্ধপদ, মা-বাবা তখন কলকাতায় রাস্তার
আন্দোলনের জেরে ৯ দিন ধরে প্রেসিডেন্সিতে জেল খাটছেন। সেই আমার, ছোটবেলা থেকেই দল
এবং গোষ্ঠী নির্দিষ্ট করে দেওয়া কিছু বই পড়ে বেড়ে ওঠা। সেই সুবাদেই বিশ্ব উদ্ধারের
মধ্যবিত্তীয়দায়পালনওধারণের স্বসাম্প্রদায়িক পিঠ চাপড়ানো বিশ্বজ্ঞান। সহস্রাব্দের
শেষতম অষ্টম দশকের শেষের
দিকের টালমাটাল সময়ের সওয়ার হয়ে আমরা ক্রমশঃ বুঝতে পারছিলাম, যে দেশে বেড়ে উঠেছি,
সেই দেশটাকেই আমি চিনি না, সেই মানুষগুলোকেই আমি জানি না, বুঝি না – যা দেখেছি,
বুঝেছি সব বিদেশী নজরে, তত্বনির্ভর দেশ আর মানুষ চেনা। ক্রমশঃ গ্রামীণদের
উদ্ধারের মধ্যবিত্তের প্রগতিশীলব্রত পালনের মহত্ত্বম পথ ছেড়ে গ্রামীণদের দর্শণ
শেখা, তাঁদের কৃতি জানা বোঝা, ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁরা যে অতুলনীয় গ্রামীন
সভ্যতার গ্রাম্যতা বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, তার-হাল হদিস এবং পথের সন্ধান করতে আস্তে আস্তে
চেনা রাস্তার বাইরে বেরোতে শিখচ্ছিলাম। বেরোতে শিখছিলাম শব্দবন্ধটির ব্যবহার বোধহয় ভুল হল। পথে
বেরিয়েছি সেই কোন ছোটবেলা থেকেই। গ্রামেই জন্ম। কিন্তু সময়ের নিয়ম মেনে শহরে বেড়ে ওঠা।
গ্রামে যোগাযোগ ছোটবেলা থেকেই ছিল। নিজেদের
বেড়েওঠা গ্রাম ছাড়া অন্য গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল গ্রাম উদ্ধারের, সমাজ
সংস্কারের ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যবিত্তীয় ব্রত পালন।
অথচ আটের দশকের শেষ থেকে আমাদের দেশ দেখার, বোঝার, শোনার
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াটাই কেমন যেন পালটে যাচ্ছিল। বুঝতে চেষ্টা
করছিলান কোন সমাজ, কোন সংস্কারের কথা
এতদিন আমাদের পুর্বজরা বলে আসছেন! অসম্ভব বিকশিত বাংলার গ্রাম সমাজ বুঝতে, আমরা
নিজেদেরও পালটাতে শুরু করলাম। যা শিখেছিলাম শহরে, ইয়োরোপের নকল করে, ভুলতে চেষ্টা
করলাম। এখনও চেষ্টাই করে চলেছি। এক্কেবারে খোলা সাদা খেরোর খাতারমত মন নিয়ে
অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের মত পড়তে, জানতে, শিখতে সুরু করলাম আমার দেশের, গ্রামের
সংস্কৃতি, দর্শন, জীবন ধারন, কথাবলার ঢং। পরে থাকা বিদেশী চশমা খুলে সাদা চোখে
দেখতে শুরু করতে শিখলাম আমাদের গ্রামের অসম্ভব ক্রিয়াশীল, অসম্ভব দার্শনিক,
ক্ষমতার বাইরে থেকে একদম আলাদা জ্ঞানচর্চার ধারা তৈরি করা, অসম্ভব নিচু গলায় কথা
বলার মানুষদের। দ্বিজত্ব বোধহয় এই প্রক্রিয়াকেই বলে। সে চেষ্টা আজও বহমান। যত দিন যাচ্ছে
মনে হচ্ছে, অসাধারণ গ্রামীণেরা কি বিশাল এক গ্রাম্যতাই তৈরি করে ছিলেন। কিছুই
শিখলাম না। আরও কত বাকি!
No comments:
Post a Comment