সোনাধরদেরমত হাজারো সম্প্রদায়েরকৃতিতে ব্রিটিশপুর্ব সময়ে
গড়ে উঠেছিল ভারতের গ্রামভিত্তিক শিল্পের বিকেন্দ্রীভূত পরিকাঠামো। ভারতপথিক
ধরমপালজীর হিসেবে, ভারতীয় সমাজের সামাজিক উত্পাদনব্যবস্থায় ধংসলীলা চালানো ব্রিটিশ
রাজের আমলেও জং ছাড়া লোহাগলানোর সচল চলন্তিকা চুল্লির সংখ্যা ছিল ৩০,০০০এর
কাছাকাছি। প্রত্যেকটি
উত্পাদনক্ষমতা ছিল বছরে ২০ টন! এই তৃণমূলস্তরের উত্পাদকেরা কেউই শহরভিত্তিক ছিলেন
না। দিল্লির বা ধরের মিনার,
দলমাদল, বাচ্চাওয়ালি, মদনমোহনেরমত হাজারো কামান, স্তম্ভ সগর্বে আজও মাথায় বিনা-ছাতায়
অবলীলায় রাস্তায় পড়ে থাকতে পারে।
অথচ বিশ্বখ্যাত পশ্চিমি ধাতুপ্রযুক্তিতে তৈরি বাড়ির জানলা দরজার লোহার খাঁচা
ঢাকতে হয় রং, প্রাইমার মেরে; তার ওপরে প্লাসটিক অথবা সিমেন্টের রঙের চাদর জুড়ে।
তবুও জংপড়া আটকানো যায় না।
বিশ্বকর্মার সন্তান, ডোকরা কামারেরা সেদিন পর্যন্তও সারাভারতের গ্রামেগঞ্জেই ঘুরে
বেড়াতেন। কমলকুমার
মুখোপাধ্যায় অথবা মীরা মুখোপাধ্যায়ের প্রণামভরা রচনায়, কাজে এদের বিস্তৃত উদাহরণ
পাচ্ছি। সোনাধরের সমাজ
সেই গর্বিত ইতিহাসের অন্যতম অংশ।
বাঙলার
গ্রামেগঞ্জের হাজারো ডোকরা কামার অথবা ছত্তিসগড়ের বিশ্বকর্মা সমাজের সন্তান,
সোনাধর পৈয়াম বিশ্বকর্মা হাজার হাজার বছরের অতীত থেকে আজও ঈর্ষণীয়ভাবে জং ছাড়া
লোহা (পশ্চিমি ভাষায় ক্রুসিবল স্টিল) তৈরিতে অসম্ভব দক্ষ। এঁদের বাজার শুধু গ্রাম বা ভারতের শহরই ছিল না,
বিশ্ববাজারও ছিল একচেটিয়া।
এদের মত শিল্পীসমাজের হাত ধরে ভারত সারা বিশ্বের শিল্প উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশের
ভাগীদার ছিল। ভারতের উজ় ইস্পাত আজ প্রবাদ প্রতীম। অথচ বিশ্বকর্মা লোহাকাম ডোকরা
কামারদের কথা অনেকেই ভুলেছেন।
বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রাযুক্তিক সংস্থা নানান গম্ভীরতম গবেষণা করেও তাঁদের
প্রযুক্তির কুড়ও খুঁজে পান নি।
লোহায় জংপড়া সাধের পশ্চিমি প্রযুক্তি আজ ভারতীয় শহুরে সমাজে সাদরে বরেণ্য। আর সোনাধরেরা নিজেদের দেশে সরকারী পরিকল্পনায়
লৌকিক-আদিবাসী শিল্পী হিসেবে গণ্য হয়ে ব্রাত্যই থেকে গিয়েছেন।
শুধু বৈদেশিক
বাণিজ্যের চোখ ধাঁধানো জোরেই নয়, সবল দেশিয় বাজারের ওপর ভিত্তি করেই ভারত একদা কৃষি-শিল্পউত্পাদনে
বিশ্ববাজারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
ভারতবর্ষ জুড়ে, প্রায় কেন্দ্রিয় নেতৃত্ববিহীন এই উত্পাদন ব্যবস্থার অঙ্গ ছিলেন,
গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ানো, নিজেদেরমতকরে হাটে, বাজারে, মেলায় ছড়িয়েথাকা অসংখ্য সোনাধরেরমত
সমাজ। এঁরা আদতে কেন্দ্রবিহীন
সামাজিক উত্পাদন ব্যবস্থা।
বরেণ্য ঐতিহাসিক, গবেষকেরা ভারতের শহরজুড়ে বড় উত্পাদকেদের গিল্ড ব্যবস্থা নিয়ে
বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। লেখকের ধারণা
শহরজোড়া গিল্ডগুলির মোট উত্পাদনের তুলনায় গ্রামীণ সমাজভিত্তিক শিল্প উত্পাদকেদের
উত্পাদন পরিমান ছিল অনেক অনেক বেশি, অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ।
আদতে সোনাধরেরা
ভারতজুড়ে এক নতুন ধরণের প্রযুক্তিরই বিকাশ ঘটাননি, সচেতনভাবে নতুন ধরণের উৎপাদন
ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন, যা আজও বিস্ময়কর বলেও অত্যুক্তি হয় না। সারা ভারতে
শহরে দু-একটি বাদে, প্রত্যেকটি গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল অকেন্দ্রিভুত।
প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার, লাখ, কোটি শিল্পী ছিলেন। পশ্চিমি উত্পাদন
ব্যবস্থার সূত্রমেনে এরা কেউই কিন্তু একক উদ্যমে বড় কারখানা তৌরিতে উদ্যমী হন নি। ব্রিটিশপুর্ব ভারতে এটি কম বড় ব্যবস্থাপনা নয়। যখন রেলগাড়ি (একদা ভারতে
যার নাম ছিল মন্বন্তর রেখা বা ফেমিন লাইন)র চল হয় নি, যখন দ্রুত পরিবহণ বলতে ছিল শুধু
জলপথ, তখনই বোধহয় কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হওয়ার সময়। অথচ কয়েক হাজার বছর ধরে গ্রাম ভারত ঠিক উলটো কাজটি করে এসেছে অসম্ভব দক্ষতাময়
ব্যবস্থাপনায়।
No comments:
Post a Comment