অঞ্জন সেন
প্রবন্ধটি
প্রকাশিত হয়েছিল বুকপকেট নামক একটি অন্তর্জাল পত্রিকায়। লিঙ্কতি হল http://bookpocket.net/archives/lekha/kalighat-pot
কালীঘাটের
পট বাংলার শিল্পীদের মৌলিক অবদান। এ ধরনের চিত্র ভারতে বা বিশ্বের অন্য কোথাও আগে
আঁকা হয়নি। দেশীয় শিল্পের চলমান ধারা থেকেই এর উদ্ভব। তুলির বলিষ্ঠ চালনায় এর
সূত্রপাত। প্রয়াত ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্তকে একবার তাঁর এক বন্ধু দুটি ড্রয়িং দেখান, পাশাপাশি রাখা, একটি কালীঘাটের পট অপরটি পিকাসোর
শ্রইং চিংড়ি মাছ। প্রদোষবাবুর মতো অত অভিজ্ঞ ভাস্করও ধরতে পারেননি কোনটি পিকাসোর
কোনটি কালীঘাটের পটুয়ার,
এমনই সে সাবলীল রেখার শক্তি।
কালীঘাটের পট আঁকা শুরু করেন কুমোর
সম্প্রদায়। এঁরা প্রতিমা ও পুতুল তৈরি করতেন, প্রতিমা তৈরির সময় চালচিত্র আঁকতেন। কালীঘাটের
মন্দির নতুন করে তৈরি হয় ১৮০৯ সালে। ধীরে ধীরে তীর্থযাত্রীদের আসা যাওয়া বাড়তে
থাকে। এই তীর্থযাত্রীদের জন্যই কুমোর শিল্পীরা কালীঘাটে পট আঁকা শুরু করেন, তীর্থযাত্রীরা ফেরার সময় পট কিনে নিয়ে
যেতেন। সম্ভবত ১৮৩০ বা কিছু আগে পরে কালীঘাটের পটের বহুল প্রচলন হয় এবং প্রথম দিকে
এগুলি ছিল সাদা কাগজে কালো কালির সাবলীল ড্রইং। চিত্রগুলির ডৌলতা প্রতিমার ডৌলতার
মতো,
এ থেকেই বোঝা যায় মূলত প্রতিমা ও পুতুল
তৈরির শিল্পীরা এই ধরনের পট আঁকা শুরু করেন। প্রতিমার চালচিত্রে কুমোরদের অঙ্কিত
যে চিত্রগুলি দেখা যায় তার সঙ্গেও কালীঘাটের রেখাচিত্রগুলির মিল আছে। এই শিল্পীরা
এসেছিলেন দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। প্রথম দিকে কেবল দেবদেবীর
মূর্তি আঁকা হত,
পরে তা নানান সামাজিক ঘটনাবলীর
দৃশ্যরূপ,
কোথাও নটি, বাবু, নাটকের দৃশ্য, গুরুঠাকুর, মেছুনি, নর্তকী, কামাখ্যার পুরুষদের ভেড়া বানানো। তারকেশ্বরের
মহান্ত আর এলোকেশীকে নিয়েও আঁকা হয়েছে বহু সংখ্যক পট। কালো কালির ড্রয়িং থেকে
পটুয়ারা রঙিন পট আঁকতে আরম্ভ করলেন, আরম্ভ করলেন বিলিতি জলরঙে আঁকা। বহু সংখ্যক রঙিন
পট আজও সংগ্রহশালাগুলিতে দেখা যায়।
অনুমান করা হয় চিৎপুরের চিত্তেশ্বরীর
মন্দিরের (প্রতিষ্ঠা ১৬১০?)
কাছে এক শ্রেণির পটুয়ারা থাকতেন, ওই ওঞ্চলে ডাকাতের প্রবল উৎপাতে তাঁরা
কালীঘাটে চলে এসেছিলেন। সূত্রধর সম্প্রদায়ের শিল্পীরা আরও কিছু পরে এসেছিলেন।
বাংলার সূত্রধর শিল্পীদের আলাদা একটা শৈলী ছিল যা আমরা পুঁথির পাটাচিত্রে, মন্দির গাত্রের টেরাকোটায়, কাঠের পুতুল বা মূর্তিতে আরও অনেক আগে
থেকেই দেখে আসছি। কুমোর সম্রদায়ের শিল্পীদের অঙ্কনে যে প্রতিমাসুলভ ডৌলতা দেখা যায়
সূত্রধর সম্প্রদায়ের শিল্পীদের অঙ্কনে তার পরিবর্তে আছে ঋজুতা। কালীঘাটের পটে
কোথাও কোথাও এই দুই শ্রেণির শিল্পীদের আদান প্রদান ঘটেছে।
কালীঘাটের পটুয়াদের
সঙ্গে অনেকে ভুল করে জাত পটুয়াদের গুলিয়ে ফেলেন। জাত পটুয়ারা ধর্মে মুসলমান, দীঘল পট বা লাটাই পট দেখিয়ে এঁরা গান করে ঘুরে বেড়ান মূলত পৌরাণিক আখ্যান
নিয়ে। এছাড়া ওই শৈলীতেই পড়ে গাজি পট, যম পট, সাঁওতালি পট। এঁরা বহু প্রজন্ম থেকেই এভাবে পট দেখিয়ে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ান, এখনও এঁদের অস্তিত্ব রয়েছে। এই জাত পটুয়া সম্প্রদায়ও অনেক উৎকৃষ্ট চিত্র
সৃষ্টি করেছেন কিন্তু কালীঘাটের পট এঁদের সৃষ্টি – এ ধারণা ভুল আর এঁদের
চিত্রকলা লৌকিক পর্যায়েরও।
No comments:
Post a Comment