সোনাধরকে নিয়ে লেখা যেমন উৎসাহের; তেমনি আবার দ্বিধারও। সোনাধর নিয়ে বোধহয় ব্যক্তিগতভাবে বলার কিছু নেই খুব একটা, শুধু কিছু
মধ্যবিত্তীয় কিছু শৈল্পিক আদিখ্যেতা ছাড়া। কোনও কোনও মানুষ কখনও
কখনও তাঁর গোষ্ঠী পরিচয় থেকে বড় হয়ে ওঠেন। সোনাধর তেমনি শিল্পী। কিন্তু আবার
সোনাধরেরমত শিল্পী-প্রযুক্তিবিদ, যার জীবনরসদের শিকড় চারিয়ে রয়েছে গোষ্ঠীর গভীরতম
ঐতিহ্য, গোষ্ঠীর ব্যাপ্ত ইতিহাস, তার দীর্ঘ জ্ঞানচর্চার পদ্ধতির সঙ্গে, তখন শুধু
ব্যক্তি সোনাধরের মহত্ব, কৃতি বিষয়ে আলাদা আলোচনায়, লেখকের শহুরে অহংএর
পৃষ্ঠকণ্ডুয়নেরসোয়াদ এবং আত্মপ্রচার মেলে ঠিকই, কিন্তু এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির
শিল্পী হয়ে ওঠার গোষ্ঠী অবদানের পরিচয়টি যেন লুকিয়ে পড়ে। ফলে লেখকের বিড়ম্বনা
বাড়ে বই কমে না। সেই বিড়ম্বনা কেউ বোঝেন, কেউ বোঝেন না।
তাঁর সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলা যাক, সোনাধর ছত্তিসগড়ের
বস্তার অঞ্চলের পারম্পরিক সম্প্রদায়ের ধাতুবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ। প্রখ্যাত
কিছু শহুরেদের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রায় সারা বিশ্ব ঘুরেছেন। বিশ্বের প্রখ্যাতসব
সংগ্রহশালায় তাঁর কাজ রয়েছে। তিনি বস্তারের লোহাকাম, বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের অতি
গুরুত্বপুর্ন একজন শিল্পী-প্রযুক্তিবিদ, যিনি এবং তাঁর বাবা, তাঁদের সম্প্রদায়ের
কৃতি, ইতিহাস সঠিকভাবে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের সমাজের বাইরেও। এহেন সোনাধর যদি শোনেন
তাঁর জীবন বৃত্তান্ত বাংলার এক অখ্যাত গ্রামকর্মী লিখছেন, আমাদের বিশ্বাস তিনি
শুধু হয়ত কপালটি একটু কুঁচবেন। ব্যস! তারপরে জীবন যে রকম চলছিল বয়ে চলতে থাকবে।
আমরা তাই, এই প্রবন্ধে, সোনাধরকে চেনাতে চেষ্টা করছি, তাঁর সম্প্রদায়ের কাজ
চেনানোর মধ্যে দিয়ে, তাঁদের দর্শন চেনানোর মধ্যে দিয়ে, তাঁদের সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য
বাখানের মধ্য দিয়ে। এই প্রবন্ধে, আমরা চেষ্টা করব, সোনাধরের পক্ষ থেকে, তাঁর
সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য, ভারতের গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার মূল কাঠামো তুলে ধরতে। এবং
আমাদের মত করে আমরা জানাতে চেষ্টা করব, আমরা কেন মনে করি, আজকের বিশ্বে সোনাধরদেরমত
গোষ্ঠীগুলোর গভীরতম চর্চা প্রয়োজন।
সোনাধর পৈয়াম বিশ্বকর্মার সঙ্গে প্রথম আলাপ এই সে
দিন। ২০০৯ সালে। সল্টলেকের
সেন্ট্রাল পার্কে ভারত সরকারের গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রযোজনায় চলা হস্তশিল্প মেলায়।
সেদিনের কলকাতা থেকে প্রকাশিত, প্রচারিত খবরে জানার উপায় ছিল না যে, সোনাধর
কলকাতায় এসেছেন। শুধু ভারত নয়, বিশ্ব সভ্যতার ধাতুবিদ্যা জ্ঞানচর্চার বিকাশে, যদি
কয়েকটি সম্প্রদায়ের নাম করতে হয়, তবে বস্তারের সোনাধর বিশ্বকর্মা যে সম্প্রদায়
থেকে এসেছেন, সেই লোহাকাম বা বিশ্বকর্মা সম্প্রদায় এই তালিকার প্রথমের দিকে থাকার
অন্যতম অধিকারী। ভারত তথা বিশ্বসভ্যতার(আমরা বলি গ্রাম্যতা। শহর পৃথিবী ধংস করে।
গ্রাম পৃথিবী গড়ে।) বিকাশে তার সম্প্রদায় অসম্ভব এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
এসেছেন, এখনও সেই জ্ঞান বহন করে চলেছেন; ইয়োরোপীয় পদ্ধতিতে পড়াশোনা করা উচ্চমধ্যবিত্ত
পণ্ডিতেরা স্বীকার করুন ছাই না করুন। তাঁরা এবং ভারতের অন্যান্য পারম্পরিক ধাতুবিদেরা
কয়েক হাজার বছর আগেই এক অদ্ভুত প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। সে প্রযুক্তিটি হল, জং
ছাড়া লোহা তৈরির প্রযুক্তি। আজও পর্যন্ত সেই বিদ্যার আশেপাশে পৌঁছতে পারেনি
আধুনিকতার, সুক্ষ্ম প্রযুক্তির শেষ কথা বলার স্বঘোষিত নেতা পশ্চিমি তথাকথিত আধুনিক
প্রযুক্তি।
No comments:
Post a Comment