বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই লোহা এবং ইস্পাত তৈরি এবং ব্যবসার
নানান সুযোগ তৈরি হতে থাকে। বাংলার লোহা প্রযুক্তিবিদেরা বিদেশী কারিগরদের সঙ্গে
হাত মিলিয়ে লোহা শিল্পে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বাংলায় লোহা শিল্প মুস্লিমদের দ্বারা
এতই প্রভাবিত যে, বাংলার প্রাচীন অস্ত্র শিল্পের বিশিষ্টতা বর্ননা করা এখন প্রায়
অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাংলার পাটনা, মুঙ্গের, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং
বর্ধমানে যে ধরণের অস্ত্র তৈরি হয় তাঁর সঙ্গে পারস্যের, আরবের এবং পাঞ্জাবের
অস্ত্রের বিন্দুমাত্র কোনও পার্থক্য নেই। মুসলিম সাম্রাজ্য যে সব ধরণের শস্ত্র
তৈরির উদ্যম নিয়েছিল সে তথ্য আজ যথেষ্ট পুরনো। আকবর নিজে উচ্চশ্রেণীর ধাতুবিদ
ছিলেন এবং যেকোনো অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। ইয়োরোপের প্রখ্যাত ধাতু এবং
অস্ত্রবিদেরা আকবরের সভার এসে নিজেদের হূনর জাহির করতেন এবং আকবর তাদেরকে কাজ করার
সুযোগও দিতেন।আকবর ছোট ছোট অস্ত্রের প্রতি নজর দিয়েছিলেন এবং আকবরের সময় কামান
ব্রাসেই ঢালাই করা হত।
পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতে বাংলায় কি ধরণের শস্ত্র তৈরি হত তার কোনও নিদর্শন আমরা
এখন আর পাই না। মুর্শিদাবাদে জাহানকোষা নামে একটি বিশাল কামান পড়ে রয়েছে। এতে একটি
ছাপ রয়েছে, যা থেকে বোঝাযায় এটি জাহাঙ্গীরনগরে, আজকের ঢাকায় তৈরি হয়েছে। এটি তৈরি
করেছেন জনার্দন কর্মকার, শেরে মহম্মদের নজরদারিতে এবং সে সময় এটির কারনিক ছিলেন
হরবল্লভ দাস। এটি ১১ জুলুস বছরের জামাদিসানি মাসে অর্থাৎ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি
হয়। কামানে আরও একটি ছাপ রয়েছে, যার থেকে বোঝাযায় এই কামান তৈরিতে আটটি ধাতু(অষ্টধাতু)
– সোনা, রূপা, তামা, দস্তা লেড, জিঙ্ক, পারদ, লোহা আর টিন ব্যবহার হয়েছে। তবে খালি
চোখে দেখে মনে হচ্ছে এটি মুলতঃ লোহা দিয়েই তৈরি। ধাতুতে জঙের চিহ্নমাত্র নেই, যা
তার বয়স অনুযায়ী আশ্চর্য জাগায়। এই ধাতুর ভৌত ও রাসায়নিক পরীক্ষা নানান ধরণের
প্রশ্নের সমাধান করতে পারে – বিশেষ করে তার তৈরির পদ্ধতিটি। কামানের চোঙায়
খাঁজকাটার(রিব-লাইক মার্কিং) দাগ রয়েছে। এবং বাচ্চাওয়ালি কামান তৈরিতে যে ধরণের
প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, এটি তৈরিতে প্রায় একই ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার
হয়েছে। আধুনিক কালে যেমন আমরা বড় কামান তৈরি করি ঠিক সেই ভাবেই দুটো বা তিনটে টিউব
জুড়ে জুড়ে কামানের নলটি তৈরি হয়েছে। কামানের বাইরের অলঙ্করণ অবশ্যই রট লোহায় করা
হয়েছে। এবং এই অলঙ্করন অনেকটা ফ্লোরেন্স বা মধ্যপ্রাচ্যের ধাঁচের। ‘কামানটির দৈর্ঘ
সাড়ে সতের ফুট, টাচহোল এন্ড গার্থ পর্যন্ত ৫ ফুট। টাচহোল বেধ দেড় ইঞ্চি।
মুখটি(অরিফিস) ছয় ইঞ্চি। এটির ওজন ২১২ মন এবং এটি থেকে গোলা ছুঁড়তে ২৮ সের বারুদ
প্রয়োজন হয়।
তবে অষ্টাদশ শতকের নানান ধরণের অস্ত্র শস্ত্র দেখা যায়। বর্ধমানের মহারাজা
প্রত্যেকটা শস্ত্রের ইতিহাস তৈরি করেছেন। বর্ধমান থেকে আট কিমি অদূরে কামারপাড়ায়
বহু কামার থাকেন যারা রাজার জন্য অস্ত্র তৈরি করেন। মহারাজার একটি তরোয়ালের গল্প
বলা যাক- কামারপাড়ার এক কামার ১৭০০ সালে জঙ্গী রাজা চিত্র সেন রায়ের বাবাকে একটি
তরোয়াল বিক্রি করতে আসেন অতি উচ্চ দামে। রাজার সভাসদেরা তাকে উপহাস এবং লাঞ্ছনা
করে তাড়িয়ে দেয়। চলে যেতে যেতে সে দেউড়ির সামনে একটি গাছ এমনভাবে কেটে দেয় যে সেই
কাটাটি বোঝা যার না। ক্রমশঃ গাছটি শুকিয়ে যেতে থাকলে রাজার নজর পড়ে। তিনি তদন্ত
করে বুঝতে পারেন কি ঘটনা ঘটেছে। তখন রাজা সেই কামারকে ডাকিয়ে এনে তারই বরাদ্দ দামে
সেই তরোয়ালটি কিনে নেন। ১৭৬১তে ক্যাপ্তেন মার্টিন হোয়াইটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
মহারাজা ত্রিলোকচাঁদ বাহাদুর যে ম্যাচলক বন্দুকগুলি ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলি এখনও
সেই প্রাসাদে রয়েছে। নানান ধরণের যন্ত্রপাতিও রয়েছে যা সেগুলো সারাতে কাজে লাগে।
এদের মধ্যে তিনটি হল বিচ্ছু, বিগলি আর বার্ছা।
মুর্শিদাবাদের মহারাজার অস্ত্রগুলি পাটনায় তৈরি। মুঙ্গের বন্দুকের জন্য
বিখ্যাত। কামারপাড়ার ম্যাচ লকের মত করে মুঙ্গেরের বন্দুকগুলো তৈরি হত। শতাব্দীর
শেষের দিকে ব্রিটিশদেরমত করে মুঙ্গেরে বন্দুক তৈরি হতে থাকে। ভাগলপুরের একটি
তরোয়াল তার ধারের দিকে কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। মুর্শিদাবাদের অপরাধীদের হত্যার
জন্য তৈরি তরোয়ালের(টেগা বার্ডওয়ানি) আকৃতি দেখার মত। আমাদের ধারণা, মুর্শিদাবাদের
কামারেরা বর্ধমানের এই গ্রাম থেকে যাওয়া। এই সময়ের বাংলার অস্ত্রের চরিত্র হল ঝুব
সাধারণ আকারের এনং তাতে অলঙ্করনের অভাব। তবে মুর্শিদাবাদের কিছু অস্ত্র রয়েছে
যেগুলিতে বাংলার নিজস্বতার ঝলক দেখা যায়।
No comments:
Post a Comment