এসব দিয়ে চিনলাম কর্পোরেট শহর গ্রেটার নয়ডা আর তার
অন্যতম বাসিন্দা প্রবাসী বাঙ্গালীদের। গ্রেটার নয়ডা কালীবাড়ির পুজোয় যাওয়ার অন্যতম
উৎসাহ ছিল উদ্যোক্তাদের উদাত্ত আহ্ববান, নম্র ব্যবহার। ছোটবেলা থেকেই প্রবাসী
বাঙ্গালীদের নিয়ে গ্যাদ্গ্যাদে নানান সব লেখা পড়ে মুগ্ধ ছিলাম। জানতাম তারা বিদেশে
বাংলার দূত। বিদেশে অনেক কষ্ট করে বাংলার সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখছেন। মাস চারেক আগে
গ্রেটার নয়ডার ওয়াইএমসিএতে প্রদর্শনী করে যে মানসিক শক্তি অর্জন করেছি, সেটিও
আমাদের এই মেলায় টেনে নিয়ে গিয়েছে। তবে মেলায় করার আগে বুঝিনি, বিদেশের বাঙ্গালিরা
বাপদাদার অনুসরনে, বিদেশী কর্পোরেট সংস্কৃতি, নিজ দায়িত্বে বাঁচিয়ে রাখছেন।
ষষ্ঠীতে দোকান সাজিয়ে বসি। কিন্তু খুব একটা কিছু
বিক্কিরি হয় নি। পরের দিন সক্কাল থেকেই বিকেল পর্যন্ত টানা ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। সন্ধ্যে
জুড়ে ব্যাপক ঠাণ্ডা। মানুষ এলেন কম। তার পরের দুদিন ভাল বিক্কিরি হল ঠিকই, কিন্তু
মনে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। মেলায় যদি স্থানীয় অবাঙ্গালীরা না আসতেন, তাহলে যা নিয়ে
গিয়েছিলাম, তার ৯০% ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হত। মেলায় বাঙ্গালিদেরই সংখ্যাধিক্য। অথচ
বাঙ্গালিদের কেনার আগ্রহ কম। কেউ ২০০ টাকার বেশী জিনিস কিনছেন না। তাও দর দাম করে,
দর কমিয়ে এনে। সেই ইংরেজ আমল থেকে মধ্য-উচ্চবিত্ত বাঙালি কর্পোরেটসেবী। ব্রিটিশদের
ভারত লুঠ কারবারের সহায়ক, ভাগীদার। আজও সেই মানসিকতা বদলায় নি। ১৭৫৭র আগে থেকেই
দাদনী বনিক এবং সরকারের নানান ধরনের দপ্তরের সঙ্গে জুড়ে থাকা আমলারা একটু একটু করে
সারা বাংলা শুষে ব্রিটিশরাষ্ট্র গড়ায় বড্ড উদ্যমী ছিলেন। ক্রমশঃ কলকাতায় থিতু
হচ্ছেন। পলাশীর পর এই উদ্যম উদ্দাম গতিতে দৌড়েছে। ১৯৪৭এর পর সেটি আরও জোর পেয়েছে।
১৭৬৩ থেকে যখন সারা দেশ ফেটে পড়েছে স্বাধীনতার লড়াইতে
তখন প্রথমে ক্লাইভ, পরে হেস্টিংস আর কর্নওয়ালিসের সঙ্গে মিলে নবকৃষ্ণ, কৃষ্ণকান্ত নন্দী, নন্দকুমার, রেজা খাঁ, দেবী সিং, গঙ্গা গোবিন্দ
সিং, প্রাণকৃষ্ণ বসু আর তাদের উত্তরাধীকারেরা ব্রিটিশসৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামক গণহত্যায় প্রাণপাত
করে রেকর্ড পরিমাণ খাজনা তুলছে, সর্বস্বহীন গ্রামীণদের ট্যাঁক কেটে, আধমরা বাঙ্গালি-বিহারীর ওপর অবর্ননীর অত্যাচার
চালিয়েছে। সে প্রবাহে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র,
দ্বারকানাথ ঠাকুরদের আবির্ভাব। তারা আজও এত বিখ্যাত কেন? লুঠেরা ব্রিটিশ রাজত্ব
টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছেন। কর্পোরেট বাঙালি সেই প্রতিদান দিচ্ছে। সেই রেশ আজও চলছে। ভাঙাপায়ে কেপ টাউনে জাহাজে
রামমোহন রায় ফ্রান্সের ত্রিবর্ন পতাকা স্যালুট করেন। কিন্তু তার বা তার দেশের
কোম্পানি পোষিত নীলকরেরা, রায়তদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এইটুকু তথ্য ভারতের আধুনিক
মানুষটি চেয়েও দেখলেন না।
বাঙালি মধ্যবিত্তদের জীবনে
কর্পোরেটভজন অন্যতমগুরুত্বপুর্নকর্ম। অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের তুলনায়
বাঙালি একটু বেশীই কর্পোরেটাসেবী। তার বাবা, ঠাকুদ্দা, তার ঠাকুদ্দা কখনও সরাসরি,
কখনও পরোক্ষে সেবা করেগিয়েছে ব্রিটিশ সিংহের। পশ্চিমি সভ্যতার ভিত্তিভূমি
কর্পোরেটিয় লুঠভিত্তিক অত্যাচার। বাল্যকাল থেকেই লুঠেরা কর্পোরেটধন্য হয়ে উঠতে
বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় সে প্রাণপাত করেছে। কত ভালভাবে কর্পোরেটদের সেবা করাযায় সেই
তত্বে নিজেকে নিজের শেকড়ের সঙ্গে বিযুক্ত করে গড়ে তুলেছে চরম দাস্য মনোভাবে। একটু
স্বচ্ছল পরিবার হলে, বা জলপানি নিয়ে ইংলন্ডে(আজ জুড়েছে আমেরিকা) পড়া, চাকুরি, বাস আর
একটু বেশি হলে মেম বিবাহ; শেষ জীবনে নীরদ চৌধুরীর মত আরও বেশী সাম্রাজ্য সেবায় মন
দেয়ন। বড় বড় মিডিয়াধন্যসব পুরস্কার পাওন। আর ভারতের ভালোর জ্যাঠামশাই হয়ে বসন। এর
বাইরে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর জীবনে সব কিছু শূন্য। যে সব হতভাগ্য সমুদ্রপার হতে পারেন
না, বা বিখ্যাত হতে পারেন না? তাদের মনের ছোট্ট কোনায় পুষে থাকে একটুকরো ইয়োরোপ বা
আমেরিকা আর বিশাল বড় দীর্ঘশ্বাস। শয়নে, বসনে, ব্যাসনে, বলনে শুধুই ইয়োরোপ,
আমেরিকার জীবনযাত্রার হনুকরন। জীবনে, মরণে কর্পোরেটধুম্রসেবন।
No comments:
Post a Comment