নীরদ চৌধুরী যাদের বাঁদরপুজক বলে গালি দিয়েছেন(সঙ্গে
মার্ক্সও), তারা সাম্রাজ্যসেবী হয়ে উঠতে পারেন নি বলে শেষ বয়স পর্যন্ত হাহুতাশ
করেছেন, সেই গাঁইয়া জাঠরা, হিন্দিভাষীরা, আমাদের উদ্ধার করলেন। ১৫০ টাকার পাটের
জুতো, ২০০ টাকার পাটের থলে তারা দরদাম না করেই কিনলেন। অনেকে ৭/৮টাও। তারা যে সকলে
মধ্যবিত্ত তাও নয়। পাশের বাজারে মুরগি আর ছাগল কাটা ইসলাম ধর্বালম্বী ছেলে ছোকরারা
অনেক কিছু কিনল। অন্য প্রদেশের হিন্দিভাষী মধ্যবিত্তরাও কিনলেন বহু কিছু। অথচ
এদেরই বুকের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে, বুকের চুল উপড়ে এই শহরটি বানিয়েছিলেন দলিত কন্যা
মায়াবতী; যেমন করে জলপাইগুড়ির চাঁদমনি চা বাগান উচ্ছেদ করে, বোলপুর, বর্ধমান,
উত্তর ২৪ পরগনার কৃষক উচ্ছেদ করে নানান পশ্চিমধন্য শহর বানিয়েছিলেন বামপন্থীরা।
আলাপ হল লেনা তাউএর সঙ্গে। বয়স ৭০ এর ওপর হাট্টাকাট্টা
চাষি। তার ছিল ৩০ একর জমিন। ভাই বেরাদারদের আরও কয়েকশ একর চাষ জমি হড়পে নিয়ে
মায়াবতী সরকার উপহার দিয়েছে জে পি গ্রুপকে। তারা আবার সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছে কয়েকশ
বড় মাঝারি কোম্পানিকে। লেনাতাউ আর তাঁর আত্মীয়দের জমিতেই গড়ে উঠেছে বুদ্ধ রেসিং
সার্কিট। কোনও রাজনৈতিক দল তাদের পাশে দাঁড়ায় নি। মুলায়ম ক্ষমতায় এসে নকল করছেন
মায়াবতীর উন্নয়ন কর্মকান্ড। তাউএরা আদালতে গিয়ে শহর তৈরির স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। আজও
লড়ছেন জমিহাঙ্গর বাড়িমাফিয়া আর তাদের সর্বভারতীয় মধ্যবিত্ত সেবকদের বিরুদ্ধে, যার
একটা বড় অংশ বাঙালি, এনজিও। আমরা ছিলাম হিমসাগর অ্যাপার্টমেন্টে। আধা সেনা বর্ডার
রোডসের কর্মীদের থাকার যায়গা। ভোলা বলল এই এলাকার সব থেকে বড় এলাকা দখল করেছে সেনাবাহিনী।
রাষ্ট্র-কর্পোরেট-সেনাবাহিনীরস্বার্থের কি অদ্ভুত গলাগলি। অফিসারদের বউদের সমিতি
কয়েক হাজার বাড়ি বানিয়ে সেনা কর্মীদের বেচেছে লাভ করেছে কয়েকশ কোটি টাকা। দেখলাম
ইন্ডো-টিবেটান পুলিসসহ আরও অনেক আধা সেনার কর্মিদের বাসস্থান। তার এক/দু কিমি দূরে
খালি মাঠে চাষ হচ্ছে। এরকম এক হৃদয়হীন শহরে চাষের মাঠ দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল।
এক বিহারী চাকুরীজীবী তার সন্তানের হাত ধরে এসেছেন। তিনি
প্রত্যেকটা শিল্পের সামনে গিয়ে জানছেন, সন্তানকে বোঝাচ্ছেন, আর বলছেন বাঙ্গালিরা
খুবই সংস্কৃতিবান। বলছেন, দেখেছ কি সুন্দর সব শিল্পদ্রব্য বানিয়েছেন বাঙ্গালিরা!
তিনি মোটামুটি সবদ্রব্যগুলি কিনছেন একটা একটা করে। একটা কিনছেন আর সন্তানের হাতে
দিয়ে অনুভব করাচ্ছেন তার গড়ন, ধরন, রঙ। খুব গর্বভরে। এই মানুষদের দেখে ভয়ও লাগছিল,
এরা খুব তাড়াতাড়ি লুপ্ত হয়ে যাবেন কিনা ভেবে, আর ভালোও লাগছিল যে, এখনও গ্রামীণ
ভারত টিকে রয়েছে। এই মানুষগুলো সেই টিকে থাকাকে তাদের সাধ্যমত সাহায্য করছেন। বলা
উচিতছিল, কিন্তু বলতে পারলাম না, ইংরেজ সময় থেকেই কর্পোরেটসেব্য বাঙ্গালিরা
নিজেদের শিল্প সচেতন হিসেবে সারা ভারতে প্রচার দিয়েছে। কিন্তু সত্যিটা এক্কেবারে
বিপ্রতীপ। আপনাদেরমত, আজ আর কোনও ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত, তার সন্তানকে
হাত ধরে শিকড়ের সন্ধান দেয় না। বাংলা ভাষা, বাংলাকে না জানার গর্ব অনুভব করে। এক কর্মকর্তা কথার টানে এখনও মেদিনীপুরের মাটির
গন্ধ পরিষ্কার। তিনি দোকানে এসে একটা শিল্প কিনে ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, ও বাংলা
ভুলেছে, ওর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলুন।
No comments:
Post a Comment