যদুনাথ সরকারের অনুবাদ
(ছবিতে গোলকুণ্ডা দুর্গ অবরোধে আওরঙ্গজেব)
(ছবিতে গোলকুণ্ডা দুর্গ অবরোধে আওরঙ্গজেব)
আওরঙ্গজেব হিন্দুদের যতটা ঘৃনা করতেন(যদিও তাঁর অধিকাংশ প্রজা হিন্দুই ছিল) ততটাই তিনি শিয়াদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন – যদিও তার বেশ কয়েকজন গুরুত্বপুর্ণ উচ্চপদস্থ সেনানায়ক এবং আমলা শিয়া ছিলেন; তার দৃষ্টিতে শিয়ারা মুলত পাষণ্ড(রাফিজি)। তার এক চিঠিতে ইসপাহানে এক শিয়াকে খুন করে এক সুন্নির পালিয়ে যাওয়াকে উল্লেখ করে লিখছেন, যে সত্যের কাছাকাছি, যে সত্যবাদী, সে সর্বশক্তিমানের আশ্রয় পায়। আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখছেন শিয়া-ঘাতক(রাফিজি-কুশ) নামে একটি খুকরি কত পছন্দ করতেন এবং একই নামে আরও কিছু খুকরি তার জন্যে বানিয়ে রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। তার চিঠিতে তিনি কখোনো অবমাননাকর বিশেষণ না বসিয়ে শিয়াদের নাম লিখতেন না, নরমাংসখেকো রাক্ষস (ঘুলইবায়াবানি), কাফের(বাতিল মাযাবান) ইত্যাদি তার খুব প্রিয় লব্জ ছিল। তার দরবারে উচ্চপদস্থ শিয়া আমলারা এমনই খারাপ সময় কাটাত যে তাদের সব সময় মুখমিষ্টি করে রাখতে হত। বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার দখল করতে গিয়ে শিয়া শাসকদের ওপরে তিনি তার গোঁড়া সুন্নি মত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। প্রধান কাজি সে সময়ের অন্যতম সত্যের সঙ্গে চলা মানুষ, শেখউলইসলাম পাদসাহের মুসলমানেদের মধ্যে যুদ্ধ লাগাবার কৌশলকে ইসলাম বিরোধী বলে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৎ কাজির এই প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব নাখুশ হন এবং কাজি পদত্যাগ করেন। ভবিষ্যতে সম্রাটের বার বার আহ্বান সত্ত্বেও তিনি আর কাজে ফিরে যান নি।
১৬৮৫ সালে ১ এপ্রিল বিজাপুরের অবরোধ শুরু করলেন শাহজাদা আজম এবং খানইজাহান বাহাদুর। সম্রাট যুদ্ধের কাছে শোলাপুরে(২৪ মে) থানাগাড়লেন। হঠাতই তীব্র দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেল, নতুন বাহিনী এবং খাবারদাবার এব সময়েই এসে পৌঁছল, যদিও মুঘল বাহিনীকে অভাব কখোনো পিছন ছাড়ে নি। নতুনভাবে উজ্জীবিত সেনা নিয়ে বেরাদ আর মারাঠাদের হারিয়ে দেওয়া গেল এবং অবরোধ আরও জোরদার হল। সেনাবাহিনী অসমবীরত্বে লড়াই করল। আওরঙ্গজেব শহরের বাইরে উপস্থিত হয়ে অবরোধের পরিবেশ নিরীক্ষণ করলেন(৩ জুলাই ১৬৮৬)। ১২ সেপ্টেম্বর শেষ আদিলশাহী রাজা সিকন্দর মুঘল বশ্যতা স্বীকার করলেন। রাজ্য দখল হল।
ইতিমধ্যে আরেকটা বাহিনী শাহজাদা মুয়াজ্জম বা সাহ আলম(২৮ জুন ১৬৮৫) গোলকুণ্ডায় পাঠানো হল, সম্ভাব্য বিজাপুরী হামলা রুখতে। এটি অক্টোবরে ধনীতম শহরগুলির অন্যতম হাদ্রাবাদ দখল এবং লুঠ করে। অযোধ্যার রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের মত চরমতম ইন্দ্রিয়পরায়ণ সুলতান আবুল হাসান নিজেকে গোলকুণ্ডা দুর্গে বন্দী করে রাখেন। কিন্তু তার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী মদন্না পন্থের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ সেনানায়কেরা মুঘলদের দ্বারা প্ররোচিত হচ্ছিল একটু একটু করে। ২৮ জানুয়ারি ১৬৮৭তে আওরঙ্গজেব স্বয়ং গোলকুণ্ডায় পদার্পণ করলেন এবং দুর্গ অবরোধ করলেন। প্রায় অপরাজেয় এই দুর্গেও মুঘল বাহিনী বিপুল অসুবিধেয় পড়ে। হায়দ্রাবাদে মন্বন্তর আঘাত হানে। ব্যপক বর্ষা আর ফুলেফেঁপে ওঠা নদী বয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী আসতে পারছিল না। এবং এই আকস্মিক প্রাকৃতিক আঘাতে মুঘলদের ব্যাপক ক্ষতিও হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও মুঘল বাহিনী দুর্গের বাইরে থানাগেড়ে বসে রইল একটা বিশাল পাঁচিল তুলে, যাতে কেউ ঢুকতে বা বেরোতে না পারে। এতদ সত্ত্বেও গোলকুণ্ডা বাহিনীকে টলানো যায় নি। দুর্ভাগ্যবশতঃ কিছু সেনানায়কের বিশ্বাসঘাতকতায় ২১ সেপ্টেম্বর ১৬৮৭ সালে দুর্গের পতন ঘটে। রাজাকে টেনে হিঁচড়ে বার করে বিজাপুরে তার কারাগারে থাকা ভায়ের সঙ্গে থাকতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই রাজত্বকেও মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে নেওয়া হয়। দুবছর পরে সাহসী কিন্তু অসচ্চরিত্র শম্ভুজীর ওপর এক দক্ষিণী সেনানায়ক মুকররব খান আক্রমন করে গ্রেফতার করে তাকে সাম্রাজ্যের তাঁবুতে পশুর মত হাঁটিয়ে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচার করিয়ে মারে(১১মার্চ ১৬৮৯)। রাজধানী রায়গড় দখল করে(১৯ অক্টো) মা বোন, স্ত্রী, ভাই সক্কলকে বন্দী বানানো হয়। জৈষ্ঠপুত্র সাহুজীকে সোনার শিকলি দিয়ে বেঁধে রাজসভায় আনা হয়।
No comments:
Post a Comment