(ছবিতে বিজাপুরের সম্রাট আদিল শাহ, যার রাষ্ট্র আক্রমন করে উলেমাদের বিরাহ ভাজন হন আওরঙ্গজেব)
ইসলামের জ্ঞানীরা,যাদের উলেমা বলা হয়, তাদের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের পছন্দমত সময়ে ধর্ম থেকে বিচ্যুতির নানান বিষয় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তার আগের শাসকদের মত আওরঙ্গজেবও তার সমগ্র শাসনকালে উলেমাদের সঙ্গে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েছেন, বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা কাজির পদ অলঙ্কৃত করতেন। শাহজাহানকে গ্রেফতার ও বন্দী করে আওরঙ্গজেব সিংহাসন দখল করায় প্রধান কাজী নতুন সম্রাটের ইসলাম বিরোধী পাপ কাজের পদক্ষেপকে সমর্থন না করায় তিনি কাজিকে পদচ্যুত করে আবদুল ওয়াহবকে প্রধান কাজী বানান। প্রায় এক দশক পরে আবদুল ওহায়াহাবের পুত্র শায়েখঅলইসলাম বিজাপুর আর গোলকুণ্ডা আক্রমন, অত্যাচার, দখল এবং সম্রাট বদলের প্রক্রিয়াকে বেআঅনি ঘোষণা করলে, আওরঙ্গজেব তাকে পদচ্যুত করেন এবং শায়েখঅলইসলামকে মক্কায় যেতে বাধ্য করেন। শায়েখ মক্কায় হজ করতে চলে যেতে বাধ্য হন। দেশ থেকে ধর্ম করার ছলে বহিষ্কারের পদক্ষেপটি দীর্ঘকাল ধরেই মুঘল শাসকদের অনুসৃত ক্ষমতাশালীদের প্রতিবাদ দমনের পদ্ধতি। সাম্রাজ্যের ভুল নীতির প্রতিবাদে প্রতিবাদী পদস্থ কর্মচারীদের প্রতি সাম্রাজ্য প্রধানেরা এই ধরণের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকতেন।
আকবরের সময়েও উলেমারা সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অন্যতম নিরূপন শক্তি ছিলেন। আকবর উলেমা সমাজের শিরদাঁড়াওয়ালা সদস্যদের ব্যঙ্গ এবং অপদস্থ করতেন এবং তাদের কয়েকজন প্রতিবাদীকে জোর করে প্রবাসে অর্থাত হজ করতে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। আকবরের সময়ের মতই আওরঙ্গজেবও সমস্যা সৃষ্টিকারী উলেমাদের সহ্য করেন নি, যেমন শাহজাহানের আমলের প্রধান কাজী তাঁকে সম্রাট হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করলে তিনি তাকে পদত্যাগে বাধ্য করিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে আওরঙ্গজেব তাঁর পূর্বজদের তুলনায় তাদের প্রতি কিছুটা নরম দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহন করেছেন।
ফতোয়াইআলমগিরি সঙ্কলনের সময় আওরঙ্গজেব আট বছর ধরে ১৬৬৭ থেকে ১৬৭৫ পর্যন্ত বহু সংশ্লিষ্ট জ্ঞানীর পৃষ্ঠপোষণা করেছেন। আওরঙ্গজেবের আমলে উলেমারা জননৈতিকতার নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছেন এবং তারাই জিজিয়া কর সংগ্রহ করতেন। ১৬৭৯ থেকে দেশের অমুসলমান প্রজাদের ওপর জিজিয়া কর আরোপ করেন আওরঙ্গজেব – ছাড় পান রাজপুত মারাঠা আমলা ব্রাহ্মণ ধর্মীয় নেতারা। কিন্তু জৈন, শিখ এবং অন্যান্য অমুসলমানদের জিজিয়া কর দিতে হত। জিজিয়া একশ বছর ধরে মুঘল রাজ্যে বন্ধ ছিল – এটি নতুন করে আরোপ করেন আওরঙ্গজেব, যতদূর সম্ভব উলেমাদের কাজ দেওয়ার আর সান্ত রাখার জন্যে। তাত্ত্বিকভাবে জিজিয়া উলেমাদের কাছে আওরঙ্গজেবের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছিল, বিশেষ করে যারা সম্রাটের আর তার রাষ্ট্রের ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন, তাদের দৃষ্টিতে এতদিন পরে মুঘল সাম্রাজ্য সহি মুসলমান রাষ্ট্র হল।
আওরঙ্গজেবের বহু আভিজাত, রাজ পরিবারের সদস্য যেমন আওরঙ্গজেবের বড় বোন জাহানারা, জিজিয়াকে মনে করতেন খুব খারাপ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। আওরঙ্গজেবকে কড়া ভাষায় লেখা চিঠিতে হয় শিবাজী না হয় রাণা রাজ সিংহ জিজিয়া করকে অস্বীকার করে লেখেন এটা মুঘল শুলইকুল নীতির ঘোরতর বিরোধী, যে নীতি আকবরের সময় থেকে মুঘল সাম্রাজ্যেরে প্রশাসনের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর রূপে চিহ্নিত হয়েছে।
বাস্তবে জিজিয়া প্রবর্তন করে আওরঙ্গজেব চরম ক্ষমতাশালী উলেমাদের খুব একটা শান্ত করতে পারেন নি। সে সময়ের বহু তথ্যে এটা প্রকাশ পেয়েছে জিজিয়ার অধিকাংশ আদায় নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি শুরু হয়েছিল, এর একটা বড় অংশ শেষ পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে পৌঁছত না, সংগ্রহকারীদের ব্যক্তিগত তহবিলেই থেকে যেত। এই চুরি রুখতে আওরঙ্গজেব ব্যর্থ হন।
No comments:
Post a Comment