আওরঙ্গজেরব যেমন তার পূর্বসূরীদের অনুসরণ করেছেন বহু প্রথা বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, তিনি তার মত করে নিজের পরিচিতিও তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন বিশেষ করে গদ্যময়(prosaic concern) বিচার দেওয়ার ক্ষেত্রে, নয়্য বিচারে এবং রণকৌশল উদ্ভাবনের দিক থেকে। যদিও তাঁর আগের সময়ের শাসকেরা ন্যয় বিচার দেওয়া নিয়ে বেশ উৎসাহী ছিলেন, - বিশেষ করে জাহাঙ্গির আগরা দুর্গে ষাটটি ঘন্টা বিশিষ্ট একটি বিচারের শেকল লাগিয়ে রেখেছিলেন, যারই বিচারের প্রয়োজন হত সেই এসে ঘন্টাটা বাজাত। আওরঙ্গজেবের কাছে বিচার যতটা দার্শনিক ততটা দেখনদারি নয় যতটা কার্যকরী ছিল - সর্বসমক্ষে দুর্নীতিপরায়ণ আমলাকে শাস্তি দেওয়া বা ধর্মীয় উতসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। সম্রাটের ইচ্ছে সত্ত্বেও তার প্রশাসন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবেছিল। এ ছাড়াও আওরঙ্গজেব তার নিজের শৈলীতে, নিজের জীবন দিয়ে অনুশীলন করা নৈতিকতা এবং নন্দনতত্ত্ব প্রয়োগ করতেন, মধ্যযুগের অন্যান্য সম্রাটের মত – কিন্তু ক্ষমতার আগ্রাসনের জন্যে তিনি বারবার যে নৈতিকতা, যে বিচারের কথা বলতেন, সেইটিকে প্রায়শঃই দুঃখজনকভাবে ছিন্নভিন্ন করেছেন।
আওরঙ্গজেবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সামরিক কৌশলের প্রয়োগ অসাধারণ ছিল – বলা দরকার তার সময়ে তিনি সর্বোত্তম সেনানায়ক ছিলেন। তিনি ময়ূর সিংহাসন দখল করেছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে ভাইদের বিরুদ্ধে সিংহাসনের লড়াই লড়ে। বহুকাল ধরে যে অঞ্চলটা বার বার চেষ্টা করেও মুঘলেরা তাদের সাম্রাজ্যের মানচিত্রে আনতে পারে নি, সেই অজেয় দাক্ষিণাত্যকে তিনি জয় করেছিলেন। যদিও পরিণত বয়সের দিকে যেতে যেতে আওরঙ্গজেব হয়ত তার কৌশলী পথটি দাক্ষিণাত্যে হারিয়ে ফেলেছিলেন উদ্দেশ্যহীনভাবে দুর্গ দখল করে এবং সম্রাটের বয়স্কতার আর ক্ষমতাহীন শাহজাহাদের অকার্যকরতার সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্ত আমলাদের দমন করতে না পেরে।
আওরঙ্গজেবের ক্ষমতায় বিচরণের সময় যদি কুড়ি বছর কম হত, জাহাঙ্গিরের বাইশ বছরের রাজত্বের সময়ের মত, অথবা শাহজাহানের তিরিশ বছরের রাজত্বের মত, তাহলে হয়ত ভারতের ইতিহাস অন্য রকমভাবে লিখতে হত। কিন্তু তার পরিণত বয়সে তিনি যেভাবে পুত্রদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিলেন, যেভাবে স্বতঃদুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন, এবং যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে ভুল পরামর্শ শুনছিলেন, সেগুলিও তার উত্তরাধিকারের অংশ হয়ে ওঠে এটাও মানতে হবে। ফলে আমরা এমন এক জটিল মানুষের কথা আলোচনা করছি যার চরিত্র সম্বন্ধে কোন একবগগা কথা বলা যায় না, বরং তাঁকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেখা যায় যাঁর বিপুল স্বপ্ন মুঘল ভারতের বাস্তবতায় ছেঁটে গিয়েছিল নির্মমভাবে।
No comments:
Post a Comment