যেহেতু নতুন গঠিত স্বার্থগোষ্ঠীর সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছিল পুরপুরি ব্যক্তি স্বার্থপূরণের ওপর নির্ভর করে, তাই প্রত্যেক দলের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নিজের স্বার্থের তাঁবুটার সুরক্ষা যতদূরসম্ভব বজায় রাখা, যদি স্বার্থ রক্ষা অসম্ভব হয়, তাহলে তারা দলও পরিবর্তন ঘটাত। এই বিষয়টা আমারা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি শতাব্দের প্রথম পাদে। মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তার ইচ্ছায় নাতি সরফরাজ খান মসনদে আরোহন করেন। সে সময়ের সরফরাজের পিতা ওডিসার উপসুব্বাদার মসনদ তার নিজের জন্যে চেয়ে বসলেন। সরফরাজ মুর্শিদকুলির স্ত্রীর(Riyaz, p. 2_88.) হস্তক্ষেপে মসনদ ছেড়ে দ্যান এবং এই অবস্থায় নতুন অভিজাতরা কিছুই করাতে পারল না। ব্রিটিশ কুঠির কাজগপত্র সূত্রে জানতে পারছি, বিপুল বিশাল প্রতিপত্তিওয়ালা ব্যাঙ্কার জগতশেঠ শুরুতে বুঝতে পারছিলেন না এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি করা উচিত(BPC, vol. 6, f.490, 14 Aug. 1727.)। এই গোষ্ঠীস্বার্থ যে সম্পূর্ণ ব্যক্তি যোগাযোগ আর স্বার্থে গড়ে উঠেছিল তার আরও একটা প্রমান, দুই প্রখ্যাত ভ্রাতা হাজি আহমদ এবং আলিবর্দি খান, যারা তার পরের সময়ে বাংলার রাজনীতিতে বিপুল বড় ভূমিকা পালন করবেন, তারা সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবেই উচ্চপদে বৃত হন(Riyaz, pp. 294-95.)। এরা যখন প্রশাসনিক সেবায় আসছেন, তখন এদের মধ্যে কেউই গুরুত্বপূর্ণ মনসবদার বা জমিদার গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন না।
এই যে নতুন স্বার্থগোষ্ঠীবদ্ধ মানুষেরা কিন্তু একদেহী হলেন না। বিভিন্ন সময়ের চাপেরে মুখে পড়ে গোষ্ঠীবদ্ধ বিভিন্ন মানুষ নানান রকমে সমঝোতা করতে শুরু করলেন। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে যখন সরফরাজ নবাব হলেন, তিনি তার পিতার পুরোনো মনসবদারদের পদোন্নতি ঘটাতে চাইলেন। কিন্তু সেই সময়ের বাংলার গুরুত্বপূর্ণ ত্রিমূর্তি হাজি আহমদ, দেওয়ান আলমচাঁদ এবং জগতশেঠ, যাদের তিনি তার পিতার শেষ ইচ্ছে শিরোধার্য করে নিজের পরামর্শ দাতা নিয়োগ করেছেন, তারা তার এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। দরবারের স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্যের সূচনা হল। প্রখ্যাত এই তিনমূর্তি তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের ১৭৪০ সালের বিপ্লব সংগঠিত করে আলিবর্দিখানকে মসনদে বসান। কয়েকজন মানুষের ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং শুধুই ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণের জন্যে সরফরাজ খাঁ সিংহাসনচ্যুত হন, তাঁর অদক্ষতা বা দুর্নীতির জন্যে নয় অথবা সামগ্রিক নতুন শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থেও আড় হয়ে দাঁড়ানোর জন্যেও নয়। রিয়াজের লেখক লিখছেন, This Revolution in the Government threw the City (Murshidabad-the capital) as well as the Army and the people of Bengal, into a general and deep convulsion.' (Ibid., p.320.)। এমন কি গিরিয়ার যুদ্ধে, ঘাউস খান, মীর সারাফুদ্দিন, মীর মহম্মদ বাকির খান, বিজয় সিংহ, রাজা ঘনদরব সিং ইত্যাদিকে সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সরফরাজ মারা গেলেও তার সৈন্যবাহনীর আরেকটি দল আলিবর্দির দলের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার মনসবদার-জমিদার জোটেও মধ্যেও একতা ছিল না, সারা জোট আবর্তিত হপ্ত ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যপূরণের(Ibid., pp. 311, 314-15, 319-20.) চেষতায়। ব্যক্তিগত উচ্চাশাই ছিল যে কোন জোটের মুল লক্ষ্য জোটের জোটসঙ্গীদের সার্বিক বিকাশ নয়, এটা প্রমানিত হয় আলবর্দির প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের ১৭৪৭এ আলিবর্দী বিরোধী চক্রান্তে(K.K. Datta, Alivardi, p. 81.)।
No comments:
Post a Comment