Saturday, September 8, 2018

আওরঙ্গজেবঃ দ্য লাইফ এন্ড লেগাসি অব ইন্ডিয়াজ মোস্ট কন্ট্রোভার্সিয়াল কিং৯ - অড্রে ট্রুস্কে

(ছবিতে বৃদ্ধ আওরঙ্গজেব)
প্রথম ব্যর্থ কৌশলটি হল চিন্তকেরা মেনে নিলেন আওরঙ্গজেব ধর্মীয় অত্যাচারী, ফলে তাঁকে তারা দারাশুকো বা আকবরের মত গোঁড়া মুসলমান হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করলেন। গোঁড়া আওরঙ্গজেবের মতই দারা শুকো আর আকবর বহু ভারতীয় ধারণা আত্মীকৃত করেছিলেন, ফলে তারা ‘যথেষ্ট’ ভারতীয় হয়ে, ভারতীয়দের যোগ্য শাসক হয়ে উঠেছিলেন এটাই তাদের বক্তব্য। এই কৌশলে আমরা সত্যকারের আওরঙ্গজেবকে পাই না। বরং আমরা এমন একজনকে পাই যিনি তাঁর প্রপিতামহ আকবরের তৈরি করা সহ্যশীল কৃষ্টিকে ধ্বংস করে তার দাদার থেকে রাজসিংহাসন বলপূর্বক কেড়ে নেন। এই ঐতিহাসিক বর্ণনায় আমরা দেখি সাভারকর এমন একটি কওমের কথা বলেন যাদের রাজা আওরঙ্গজেব ধর্মান্ধ হলেও আম জনতা আদতে সংশ্লেষী ভূমিকা পালন করেন। এই যুক্তি ধরে যখন রাস্তার নাম পাল্টানোর কথা হল তখন হাল্কা করেই সেটিকে যতদূর সম্ভব দারাশুকোর নামে করার কথা উঠছিল।
বাস্তবিকভাবেই দারা শুকো এবং আকবরেরও গণমানসে যাই ছবি থাকুক তারা আওরঙ্গজেবের মতই বহুবর্ণিল জটিল চরিত্র। আওরঙ্গজেবের প্রতিপক্ষ হিসেবে দারা শুকো আর আকবরের নাম ভাসানো আদতে আমাদের এই মানুষদের মুসলমানত্ব সরিয়ে তাদের আরও গভীরভাবে চিনতে বাধা দ্যায়। এই তুলনা করতে গিয়ে, ইন্দো-মুসলমান অতীতকে আমরা আদতে গভীরভাবে ধর্মীয়, এমত একটা ছবি তৈরির ভুলটাই বার বার করে থাকি। আওরঙ্গজেব মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তিনি এমনও মুসলমান ছিলেন না, যে ছবি তাঁর বর্তমান কালের সমালচকেরা বা সমর্থকেরা দ্যাখানোর চেষ্টা করেন। আর আওরঙ্গজেবকে শুধুই বিশ্বাসী বলে দাগিয়ে দেওয়া ভুল। অতীতের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ত থাকতে শাহজাদা হিসেবে কাটানোর সময় এবং তারপরের সম্রাট হিসেবে তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ করে তার সামগ্রিক চিত্রটা জানতে হবে।
---
অন্যভাবে কেউ কেউ বলছেন আমরা আওরঙ্গজেবকে খুব কঠোরভাবে দেখছি। হয়ত ভারতের সব থেকে অরাজি মুসলমান পাপী কি তাহলে দুর্বৃত্তিপূর্ণ মানুষ নয়?
এই যুক্তিটি আওরঙ্গজেবকে ভুল ভাবে দেখানোর উদ্যমের বাইরে বেরিয়ে নতুন ভাবে দেখানোর চেষ্টা করে, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের শাসনাকালের নানান উপেক্ষিত বিষয়গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যাক তিনি কখোনোই কোন অমুসলমানকে তরোয়ালের আঘাত না ইসলাম এটা বেছে নিতে বাধ্য করেন নি বা গণধর্মান্তরকরণ করেন নি। আওরঙ্গজেব হাজারে হাজারে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন নি(খুব বেশি হলে একডজন হয়ত হবে)। হিন্দুদের গণহত্যা করার আশেপাশেও যান নি। বরং তিনি আমলাতন্ত্রে বিপুল পরিমান হিন্দুদের উচ্চপদে কাজ দিয়েছেন। হিন্দু ধার্মিক গোষ্ঠী বা ব্রাহ্মণদের ধর্মকর্মে যাতে মুসলমানেরা বিশৃংখলা তৈরি না করতে পারে তার জন্যে ফতেয়া দিয়েছেন। তিনি তার প্রজাদের জন্যে নিরাপদ সড়ক এবং মৌলিক আইন শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ঐতিহাসিকদের পক্ষে যা বলা সম্ভব, আওরঙ্গজেবকে যে ছবিতে আমরা চিনি, বিশ্বাস করি, তার বিপরীতে তিনি খুব কম হিংসক ছিলেন, এটা তারা বলেছেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব সামগ্রিকভাবে দুরাচারী ছিলেন না, এমন কথা বলা আদতে আওরঙ্গজেবকে যারা নিন্দা করেন, তাদের থেকে বেশি দূরে যেতে পারলাম না। আরও ভয়ের হল আমরা ভারতের যে জটিল অতীতকে দেখি তার প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারলাম না। যে মানুষটা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত শাসন করেছেন, উপনিবেশপূর্ব রাজনৈতিক মানচিত্র এবং সময়কে নিজের হাতে গড়েছেন, তিনি আমাদের মত বিংশ শতাব্দের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সংবেদনশীলতায় আদৌ খাপ খাচ্ছেন কিনা, সে বিবেচনার থেকেও বেশি বিবেচ্য, তাঁকে এবং তাঁর সময়কে ধরারে জন্যে, সেই সেইটুকু বৃত্তচাপ থেকে বেরিয়ে আরও বড় বৃত্তে আমরা ধরতে পারছি কি না। আমাদের ভাবতে হবে আমরা কঠোর, আধুনিক স্বভাবে আওরঙ্গজেবকে কি বিচার করতে চাইছি, না কি তার মত প্রভাবশালী সম্রাটকে, তার সময়ের কাজকে, তার ধারণাকে উদ্ধার কজরতে চাইছি।
আমাদের আওরঙ্গজেবের গল্প নতুন করে লিখতে হবে নতুন ভাষ্যে। এখানে আমি একটা গল্প আপনাদের জন্যে তুলে দিলাম।

No comments: