তিনি সম্রাটদের ওজন করার দরবারি নীতি পাল্টান, যদিও নিজেকে দিয়ে আর ওজন করার কারবার করান নি, এই অধিকার দ্যান তাঁর নাতি বিদর বখতকে। এ তথ্য জানতে পারছি ইওরোপিয় মুসাফির জন ওভিঙ্কটিনের ১৬৯০এর স্মৃতিকথায়। গান বাদ্য শোনা ইত্যাদি নিয়ে নিজের ধারণা পাল্টান নি, কিন্তু পুত্রদের বলেছেন এটি সহি রাজদরবারি প্রথা। তবুও একটা কথা বলা যাক নানান প্রথা ছাঁটতে ছাঁটতে ১৬৬৯সাল নাগাদ এসে দ্যাখা গেল মুঘল কৃষ্টিতে যে সব হিন্দু প্রভাব ছিল সেগুলির অধিকাংশই দরবারি প্রথা হিসেবে বাতিল হয়ে গিয়েছে।
দ্বিতীয়, এবং যেটি আমার মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল দবারী প্রতিভা বিকাশে মুঘল অভিজাত আর তার পুত্র-আত্মীয়দের দিয়ে নানান প্রতিভার কাজ করিয়ে গিয়েছেন তিনি। এই বিষয়টি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আওরঙ্গজেব নিজে সঙ্গীতচর্চা ইত্যাদি এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু তার এক পুত্রকে দিয়ে বেশ কিছু গায়কের এবং গান বিষয়ে জ্ঞানচর্চা বিষয়ক কাজ করা মানুষদের পৃষ্ঠপোষণার কাজ করেছেন। গবেষক Katherine Schofield বলছেন, আওরঙ্গজেব পূর্ব উপমহাদেশিয় ৫০০ বছরের সঙ্গীতচর্চার ইতিহাসে সঙ্গীত বিষয়ক এত পুথি তার সময় ছাড়া আর প্রকাশিত হয় নি। ছবি আঁকাতেও এক কথা বলা যায়। পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, ১৬৬০এর পরে চিত্রকরদের দেয় ভাতা বন্ধ করে দিলেও, আজও আমরা বৃদ্ধ আওরঙ্গজেবের বহু চিত্র দেখি। সম্ভবত পোক্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে আওরঙ্গজেবের আবির্ভাব ঘটে কিন্তু দরবারি রাজনীতিতেই যেখানে মুঘল আঙ্গিকের ছবিগুলি আঁকা হত। ফারসি কবিতাও তাঁর সময়ে ব্যাপকতা লাভ করে, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবউন্নিসা নিজে মাকফি (জনৈক গুপ্ত) ছদ্মনামে প্রচুর কবিতা লিখেছেন।
আওরঙ্গজেব নিজে সরাসরি জ্ঞানচর্চকদের পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও তার অনুগামী অভিজাতরা কিন্তু তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে গিয়েছেন। ১৬৫০এর শেষের দিকে কবিন্দ্রাচার্যের বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে আগে যে লেখাটা লিখেছিলাম, তার বিপক্ষে বলা যায়, কবিন্দ্রাচার্য মুঘল অভিজাত দামেশমন্দ খান এবং মুসাফির বার্নিয়ের সঙ্গে বহুকাল কাজ করেন। আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান, প্রচুর সংস্কৃত জ্ঞানী এবং সংস্কৃত জ্ঞানচর্চায় মদত দেওয়ার জন্যে প্রখ্যাত। বাংলায় যখন তিনি সুবাদার(চলতিভাষায় নবাব), সে সময় তিনি বসন্ত রায়কে আকবরের সময় যে মহাভারত ফারসিতে অনুবাদ হয়েছিল, তার অধ্যায়গুলির সূচীপত্র বানিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শায়েস্তা খান নিজেও রসকল্পদ্রুম নামে সংস্কৃত শ্লোকও রচনা করেন। এবং সংস্কৃত কবিরাও অনেকেই আওরঙ্গজেবএর নাম নিয়েছেন। গুজরাটি মহিলাদের আমোদপ্রমোদ বিষয়ে গুজারিশতকমের লেখক দেবদত্ত কাব্যের শুরুতেই আঅরঙ্গজেব এবং তার পুত্র আজম শাহর নামোল্লেখ করেছেন।
১৬৬৯এর পরে আওরঙ্গজেবের দরবারের পরিবেশ পাল্টে যায় – কিছু কিছু সময় প্রাচুর্যপূর্ণ লাগত না। কিন্তু শাহজাহানের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে সব মুঘল কৃষ্টি বিশেষ করে নানান প্রাতিষ্ঠানিক দরবারি প্রথা এবং দরবারি পৃষ্ঠপোষণা ইত্যাদির অর্জন করেছিলেন, সেগুলির অনেকগুলিরই প্রবাহমানতা বজায় ছিল।
No comments:
Post a Comment