(ছবিতে লাহোরে আওরঙ্গজেব স্থাপিত বাদশাহী মসজিদ)
ইওরোপিয় মুসাফিরদের লেখা থেকে আওরঙ্গজেবের সময়ের মুঘল দরবারের বিশদ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমরা পেয়েছি। দিল্লিতে রাজত্ব চালানোর সময় তিনি একটি উঁচু মঞ্চে ময়ুর সিংহাসন রেখে, তার ওপরে বসতেন। দরবারে যোগ দেওয়া সুসজ্জিত অভিজাত বা আমলাদের দেহে যে সব রত্নরাজি থাকত, তার থেকে অনেক বেশি এবং অগুণতি রত্নমালা খোদিত ছিল সেই অপরূপ ময়ুর সিংহাসনে। যতদূর সম্ভব সম্রাট নিজে যে মসলিনের শিরস্ত্রান পরতেন সেটি সোনা দিয়ে বোনা এবং নানান ধরণের রত্ন্রারাজি দিয়ে খোদিত ছিল। মুঘল দরবার প্রথা মেনে তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী মুঘল অভিজাতরা সার দিয়ে দাঁড়াতেন। মেঝে ঢাকা থাকত অতীব ব্যয়বহুল কালীনে। দেওয়াল মোড়া থাকত দামি কাপড়ের পর্দায়। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছের বাইরে নহবত এক পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত মুঘল ঐতিহ্য পালন করেই। এই আভিজাত্যে মোড়া পরিবেশে আওরঙ্গজেব দরবারে বসে উপহার দিতেন এবং উপঢৌকন গ্রহণ করতেন, মুসাফিরদের স্বাগত বা বিদায় জানাতেন এবং সরকারি কামকাজ সম্পাদন করতেন।
১৬৭০ সালে পূর্বজ মুঘল সম্রাটদের কাজের/ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিপুল বিশাল সাম্রাজ্যিক প্রকল্প নিতে শুরু করেন পাদশাহ আওরঙ্গজেব নিজের উৎসাহে। উদাহরণস্বরূপ দরবারেই আট বছরের বিপুল উদ্যমে বহুসঙ্কখ্যক জ্ঞানীর সমন্বয়ে ফতায়াইআলমগিরি সঙ্কলিত হয় ১৬৭৫ সালে, যেটা মূলত হাজাফি বিচার ব্যবস্থার নির্দেশনামা বা সংহিতা। কাজ চলার সময় আওরঙ্গজেবকে এই সঙ্কলনের অংশ বিশেষ পড়ে শোনাতে হত, তিনি তাঁর মত করে পরিবর্ধন, পরিমার্জন এবং সংযোজনের নির্দেশ দিতেন। এর পরে সাম্রাজ্য জুড়ে বিচার দেওয়ার কাজের নিযুক্ত কাজিরা এই বই থেকেই রায়ের সূত্র নির্ভর করতেন। সঙ্কলিত হয় আরবিতে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এটি ফারসিতেও অনুবাদ হয়। সঙ্কলনের ধার্মিকতা, আওরঙ্গজেবের ধার্মিক মনন এবং কোন কোন বিষয় সম্রাটকে প্রজাদের নন্যে ন্যায় বিচার দেওয়ার কাজে সংহিতা তৈরিতে উৎসাহ যুগিয়েছিল, সেটাও বুঝতে পারি।
আমি এই স্তবকটি যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরি, সেটি হল সাম্রাজ্য পুষ্ট বিপুল বিশাল সাহিত্যিক কর্মের যে উদ্যোগ আকবরের সময় থেকেই নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রথাটি আওরঙ্গজেবের সময়েও ছেদ পড়ে নি। তাঁর পূর্বজদের মতই আওরঙ্গজেব বিপুল বিশাল গ্রন্থাগার স্থাপনা জন্যেও পৃষ্ঠপোষণা করেন। এছাড়াও লক্ষ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করে পাণ্ডুলিপিগুলি কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় সে্কাজ তিনি করিয়ে ছিলেন। ১৬৭০এর দশকে তিনি লাহোরে বিপুল বিশাল বাদশাহী মসজিদ তৈরি করান। স্ত্রী দিলরাসের ক্ষেত্রে পূর্বজকে অক্ষম অনুসরণ করতে গিয়ে যে ভুল তিনি করেছিলেন, লাহোরের মসজিদ সে ভুল শুধরে নিলেন তিনি। তিনি শাহজাহানের বিপুল বিশাল ইমারত তৈরির উদ্দীপনা ব্যবহার করলেন। তার পরিকল্পিত মসজিদে খোদিত ছিল ফুলের ছবি, মার্বেল পাথরের সজ্জা, খাঁজ বিশিষ্ট খিলান, এবং বিপুল বিশালত্ব – এক সঙ্গে ষাট হাজার মানুষ এখানে জমায়েত হতে পারেন। উনবিংশ শতকে একে গোলাবারুদ রাখার কাজে রঞ্জিত সিংহ এবং তার অনুগামীরা ব্যবহার করলে এটির কিছু ক্ষতি হয়। আজ এটি লাহোরের অবশ্য গন্তব্যগুলির মধ্যে অন্যতম দ্রষ্টব্য এবং অসম্ভব সৌন্দর্যের প্রতিমা হয়ে এটি মুঘল নান্দনিক কীর্তির বিজয় ঘোষণা করছে।
No comments:
Post a Comment