(ছবি - মুঘল দরবারে ইস্টার উৎসব)
আমার আখ্যানে থাকবে আওরঙ্গজেবের জীবন আর শাসনকালের বহু কম জানা বিষয় যা দিয়ে আমরা এই ভুলবোঝা সম্রাটকে গভীর ঐতিহাসিকতার আলোয় দেখতে পারি। আমার আলোচনা আওরঙ্গজেবের জীবনের সব থেকে নন্দনীয় ঘটনা মন্দির ধ্বংস, মেকিয়াভেলির মত রাজনৈতিক প্রবৃত্তি, হিংসক কৌশল, নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী হত্যা এবং আরও অনেক কিছু বিতর্কিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আওরঙ্গজেবের বিরোধীদের তৈরি করে দেওয়া আখ্যানের শুধু মাত্র বিরোধিতা করা একটা খুব ভুল কাজ হবে, কারণ এটি ইতিহাসের মৌলিক নির্দেশিকা – ঐতিহাসিক চরিত্রকে তার সময়ের ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই দেখা দরকার - তাকেই পূর্ণ করে না।
এর একটি চমতকার সমস্যা হল আওরঙ্গজেবের হিন্দুদের প্রতি মনোভাবকে কিভাবে দেখব ঐতিহাসিকভাবে নাকি রক্ষনাত্মকভাবে। গণমানসে একটি সহজ সাধারণ ধারণা আছে তিনি সব হিন্দুকেই অপছন্দ করতেন এবং তাদের ওপর কোন ছুতোতেই অত্যাচার নামিয়ে আনতেন। দায়িত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এর উত্তরে বলবেন, অবস্থা অনুযায়ী তিনি হিন্দুদের হ্যান্ডল করেছেন। মুঘল রাষ্ট্রের সঙ্গে নানান গোষ্ঠীর হিন্দুদের মধ্যে যুদ্ধ/বিরোধ লাগত, কখোনো কখোনো বেশ কিছু স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ও জড়িয়ে থাকত এর সঙ্গে। কিন্তু রাষ্ট্রিয় নীতি হিসেবে সার্বিক সহিষ্ণুতা এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আওরঙ্গজেবের আমলে সাধারণভাবে হিন্দুরা পেয়ে এসেছে, এটা তাদের অভিজ্ঞতা। এই যে আমরা ঐতিহাসিক তথ্যটিকে সঠিকভাবে সংশোধন করলাম, সেটি থেকে বুঝলাম, এতদিন তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হত তার বাইরে নতুন এক নির্মান হল, আওরঙ্গজেবের রাজত্বে সার্বিকভাবে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণীকরণ করা যায়।
বাস্তবে ঔরঙ্গজেব যে রাষ্ট্রের সম্রাট ছিলেন তার কোন overarching agenda ছিল না, হিন্দুদের নিয়ে তো বটেই। সে যুগে হিন্দু বলে কোন ধর্মীয় গোষ্ঠী ছিল না বা হিন্দুরা নিজেদেরকে সার্বজনিকভাবে হিন্দু দাবি করত না, বরং তারা নিজেদের নানান আঞ্চলিক, গোষ্ঠীগত বা জাতিগত চিহ্নতে যেমন রাজপুত, মারাঠা, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব – চিহ্নিত হতে পছন্দ করত। বহু বিশেষজ্ঞ বলেছেন হিন্দু শব্দটি ফার্সি, সংস্কৃতজাত নয় – এটির সার্বিক ব্যবহার শুরু হল ঔপনিবেশিক সময়ে। মুঘলেরাও হিন্দুদের মধ্যে পার্থক্য করত। উদাহরণস্বরূপ মহব্বত খান, ১৬৭০ সালের শুরুর দিকে কিছু সময়ের জন্যে দাক্ষিণাত্যে মুঘল অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি মারাঠাদের(যাদের তিনি হিন্দু হিসেবে ধরতেনই না) বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘল অভিজাততন্ত্রের মধ্যে রাজপুত এবং হিন্দু সেনাপতিদের পছন্দ করেছেন। মুঘল-হিন্দু সম্পর্ককে একশিলাভূত না করে আমাদের উচিত হবে আলাদা আলাদা গোষ্ঠীকে আলাদা আলাদাভাবে গণ্য ও বিচার করা। এই দিকচিহ্নে আলোচনা এগোলে পাঠক বুঝতে পারবেন, আলাদা করে সার্বিকভাবে হিন্দুদের জন্যে আওরঙ্গজেবের কোন বিশেষ নির্দেশিকা ছিল না বরং বিশেষভাবে হিন্দু অভিজাতদের নিয়ে বিশেষ আলোচনা করা দরকার যারা মুঘল রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করতেন বা ব্রাহ্মণদের নেতা ছিলেন অথবা মারাঠা সৈনিক ছিল।
যদি আমরা আজকের দিনে ধর্মীয়ভাবাপন্ন বিচ্ছিন্নতার শর্তে না ভেবে, সপ্তদশ শতকের মুঘল বিশ্ব নিয়ে আলোচনার শুরু করলে আওরঙ্গজেবের একটা অন্য বিশেষ ছবি উঠে আসে। আওরঙ্গজেব একজন ভারতীয় সম্রাট যিনি তার সারাজীবন ধরে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার এবং রক্ষা করেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেছেন এবং নীতিগতভাবে বিচার করেছেন।
No comments:
Post a Comment