ঐতিহাসিকেরা আওরঙ্গজেবের জীবনের মৌলিক তথ্যগুলি সম্বন্ধে একমত। তিনি ১৬১৮ সালের বসন্তে জন্মান। উনচল্লিশ বছর বয়সে ১৬৫৮ সালে তার প্রথম সিংহাসনে আরোহন। তিনি সমগ্র দরবার নিয়ে চলেযান দাক্ষিণাত্যে, যখন তিনি মধ্য ষাট, এবং বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এমন কি তামিলনাড়ুর একাংশও দখল করেন। ১৭০৭ সালে প্রায় নব্বই বছর নয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। একজন ঐতিহাসকের কাছে আওরঙ্গজেবের জীবনের তথ্যগুলোকে বিনিসুতোর মালায় গেঁথে তোলার চ্যালেঞ্জ হল সেটির পদ্ধতি নির্বাচন করা।
আমার বর্ণনা আওরঙ্গজেবের জীবনের গভীরতা এবং দৈর্ঘ বর্ণনা করবে কিছুটা ধারাবাহিকভাবে আর কিছুটা বিষয়ভিত্তিকভাবেও। শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের জীবন আলোচনায় আমরা বুঝতে পারি কোন কোন শক্তি যেগুলি মুঘল রাজপদ, নৈতিক কর্ম এবং রাজনীতি বুঝতে তার মনোজগতকে গড়ে তুলেছিল এবং আমরা এই বুঝতে পারি তার মনে এই ধারনাগুলি কিভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিতও হয়েছে। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তার জীবনের কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে আলোচনায় আমরা আন্দাজ ও উপলব্ধি করতে পারব কোন প্রণোদনা আওরঙ্গজেবকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল এবং সে জন্য তার নিজস্বধারার রাজনীতির কি ফলেছিল।
আমি শুরু করব তার জীবনের প্রথম চার বছরে ঘটনাবলী দিয়ে, যে সময় তিনি যুবা শাহজাদা হিসেবে আগামী সম্ভাব্য সিংহাসনের যুদ্ধে ভাইদের সঙ্গে পাঞ্জালড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুবছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর আওরঙ্গজেব সিংহাসন দখল করেন এবং তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আর চাহিদা অনুযায়ী যে শাসন কৃষ্টি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছেন তাকে বিন্যস্ত করা শুরু করলেন, যে প্রকল্প আগামি পঞ্চাশ বছরে ক্রমশ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে। আওরঙ্গজেবের শাসন কালে তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা তার শাসন কৌশল এবং ন্যয় বিচারের দৃষ্টিভঙ্গী বুঝতে সাহায্য করে – সাম্রাজ্যের আমলাতন্ত্র, তিনি নিজেকে কিভাবে নীতিনিষ্ঠ শাসক হিসেবে দেখছেন এবং হিন্দু আর জৈন মন্দির হিসেবে তার নীতিসমূহ। যে সমালোচনাগুলি ভিত্তি করে সমালোচকেরা তাকে আজও বিদ্ধ করেন সেগুলির অধিকাংশই এই তিন বিষয়ের আবর্তে জড়িয়ে আছে এবং এইগুলোই খুব কম জানা বিষয়ো বটে। সব থেকে বড় কথা, এই বিষয়গুলি আলোচনায় এমন কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি তৈরি করে এমন এক রাজার জন্যে, যাকে এতকাল আমরা একচোখেই দেখে এসেছি। এর পরে আমি আলোচনা করব তার পরের বছরগুলি, বিশেষ করে তার জীবনের শেষ দশক, যে সময়টা তার কেটেছে দাক্ষিণাত্যের সাম্রাজ্য বিস্তৃতির পরিশ্রমে এবং যা শেষ হবে তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। আমি এই ক্ষুদ্র আলোচনায় আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকার এবং একই সঙ্গে অষ্টাদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাওয়ায় তার দায়িত্ব বিষয়েও আলোচনা করব।
বিশদ গবেষণার সুবাদে আমি বলতে পারি, আমার এই লেখায় আমি এক শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে খুঁজে পাই যিনি রাজ পরিবারের ভেতরের রাজনীতির গতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ভারতের রাজা হিসেবে তৈরি করেছেন এবং যিনি নতুন রাজ্য জয় করতে সদা উদগ্রীব, রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে ভীষণ আগ্রহী বিশেষ ধরণের নৈতিক বিচার দিতে সদা উতসুক।
No comments:
Post a Comment