মুক্ত জঙ্গি অদম্য শিবাজীকে সামলানো মুঘলদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। এবং এই ঘটনা মুঘলদের পক্ষে ধ্বংসকারী হয়ে উঠল। ১৬৭০ সালে পর পর শিবাজী সুরাট এবং অন্যান্য শহর লুঠ করতে লাগলেন। এর পরে চার বছর তিনি মহারাষ্ট্রের খণ্ডেশ, বেরার, বাগলানের মত মুঘলদের শক্তিশালী ঘাঁটিতে আঘাত হানলেন এবং মুঘল আর বিজাপুরী সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করলেন প্রাণপনে। এই সময় আওরঙ্গজেব উত্তরপশ্চিমে পাঠানদের নত করতে ব্যস্ত ছিলেন।
১৬৭৪ সালে যে সময় খাইবার গিরিপথে আফ্রিদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনা অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওরঙ্গজেব, সে সময় শিবাজী নিজের রাজত্ব এলাকা পশ্চিমঘাট পর্বতমালা থেকে কোঙ্কণ উপকূলে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেকেই ছত্রপতি উপাধি দান করলেন। সমগ্র সিংহাসনে বসার আচার শেষ হতে তিন দিন লাগে এবং উৎসব চলে নয় দিন ধরে। শিবাজীর কথিত ক্ষত্রিয় পূর্বপূরুষদের ইতিহাসে এই আচারের কোন পুর্বল্লেখ পাওয়া যায় না, বেনারসের প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ গগভট্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই আচারটি তৈরি করান।
পরের ছয় বছর শিবাজী মারাঠা রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি সে সময় আভিজাত্যিক আরও কিছু কৃষ্টিগত পার্থক্য তৈরি করলেন, ১৬৭৪সালের সিংহাসনে আরূঢ় হওয়ার আচার হিসেবে তিনি ইন্দো-পারসি আচার বাদ দিয়ে সংস্কৃত/ব্রাহ্মণ্যবাদিভিত্তিক আচার প্রথার সূচনা করেন। ১৬৭৭ সালে তিনি সংস্কৃত ভাষায় রাজাব্যবহারকোষ লেখান যেখানে তিনি রাজ্যশাসনে ব্যবহৃত ১৫০০ ইন্দো-ফার্সি শব্দের সংস্কৃত অনুরূপ খুঁজে বার করার কাজেরে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই কাজ অনেকের নীতিবাগিশী মনে হতে পারে কিন্তু এই কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি মুঘল শাসন কৃষ্টি থেকে বেরিয়ে আসার পথের সূচনা করলেন। শিবাজীর শাসনের পরের বছরগুলিতে বিভিন্ন মারাঠা পাঠে আমরা ফারসি শব্দের পরিবর্তে সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য দেখতে পাই।
১৬৭৮ সালে তিনি নানান রোগে ভুগে ভুগে ১৬৮০তে মারা যান। রাজ্য জুড়ে গুজবের পর গুজব উঠল যে শিবাজীর দ্বিতীয়া স্ত্রী সোরায়াবাঈ, শিবাজীর প্রথমা স্ত্রী, সতীনপুত্র শম্ভাজীর জায়গায়, তাঁর দশ বছরের পুত্র রাজারামকে সিংহাসনে বসাবার জন্যে স্বামীকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছেন। বিষ দিয়ে হত্যার ঘটনা হয়ত মিথ্যাই, কিন্তু এটা কঠোর সত্য সিংহাসনের দখল নিয়ে দুই বৈমাত্রেয় ভায়ের লড়াই চলেছিল। শম্ভাজী এই দ্বন্দ্বে জিতে পিতার লড়ায়ের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন।
যদিও আওরঙ্গজেব এবং শিবাজী মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৬৬৬ সালে, কিন্তু তাঁরা পরস্পরকে অশ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। শিবাজীর অন্যতম সভাকবি ভূষণ আওরঙ্গজেবকে কুম্ভকর্ণ নাম দিয়েছিলেন। উল্টো দিকে আওরঙ্গজেব শিবাজীকে পাহাড়ী ছুঁচো বলতেন। মুঘলেরা তাকে সাম্মানিক জী বাদ দিয়ে শিব নামে ডাকতেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের আওরঙ্গজেবের শাসনের সময়কার ঐতিহাসিক কালানুক্রম তৈরির সময় শিবাজীর মৃত্যু তারিখ লিখতে লেখেন কাফির বি জাহান্নুম রফত(The infidel went to hell)।
No comments:
Post a Comment