ভূমিকা
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা অষ্টাদশ শতকের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করব। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করব ইওরোপিয় কোম্পানির কাজকর্ম। চতুর্থ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে কোম্পানিগুলির বাণিজ্য কর্ম এবং সওদাগর সমাজ নিয়ে আলোচনা হবে। ষষ্ঠ সপ্তম অষ্টম পর্বে সুতি ও রেশম বস্ত্র কাঠামো ও সংগঠন নিয়ে আলোচনা। নবম অধ্যায়ে ইওরোপিয় এশিয় বাণিজ্যে অন্যান্য পণ্যের প্রভাব আলোচিত হবে। দশম অধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়ে পণ্যের দামের ঝোঁক নিয়ে আলোচনা করব। একাদশ অধ্যায়ে বাংলায় ব্রিটিশ বিজয় আলোচিত হবে এবং দ্বাদশ অধ্যায়ে আলোচিত হবে আমরা যে আলোচনা করলাম বিভিন্ন অধ্যায়ে, সেগুলি থেকে কোন সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারি সেগুলি।
এই বইতে আমরা কতগুলি বিষয় উত্থাপন করব, সেগুলি হল, অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকায় আইন শৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিলেও নবাবি নেতৃত্বে বাংলায় রাজনৈতিক স্থায়িত্বর জন্যে বাংলায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। বলা দরকার অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে স্থায়ী এবং শক্তিশালী সরকারের জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। এর পরে যে ব্রিটিশ দখলদারি এবং উপনিবেশ তৈরি হল, তার জন্যে বাংলার কোন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট দায়ি নয়। দায়ি কোম্পানির আমলাদের উপউপনিবেশিক(sub-imperialism) উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং এশিয় এবং অন্যান্য ইওরোপিয় বণিকদের প্রতিযোগিতায় লড়তে না পেরে ব্রিটিশ আমলাদের প্রায় ডুবতে বসা ব্যক্তিগত ব্যবসা বাঁচানো এবং একইসঙ্গে বাংলাকে দোহন করার জন্যে উপনিবেশ তৈরি করার উদ্যম।
দ্বিতীয়ত এই বইতে আমরা তর্ক করেছি, বাংলায় ভৌগোলিকভাবে অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে কোন আর্থনৈতিক পতন ঘটে নি। মধ্যঅষ্টাদশ শতাব্দে বাংলায় বিন্দুমাত্র কোন আর্থিক সঙ্কটের চিহ্ন ছিল না, বরং বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ ঘটছিল। বাজারে লক্ষ্যণীয় এবং দীর্ঘসময়ধরে কোন দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ঘটে নি। সমগ্র ১৭৩০এর দশক বা ১৭৪০এর দশকের প্রথম দিককার বিপুল রপ্তানির তুলনায় ১৭৫০এর দশকে বাংলা থেকে ইওরোপিয় রপ্তানির মূল্যমানের কোন ঘাটতি বা পতন দেখা দেয় নি। এই সময়ে এশিয় বণিকেরা বাংলা থেকে বিপুল পরিমানে সুতি আর রেশম বস্ত্র রপ্তানি করছে। এটাও মনে রাখা দরকার পলাশীর আগের সময়ে বাংলায় ব্যাপক পরিমান দামি ধাতু আমদানি করত এশিয় ব্যবসায়ীরা, ইওরোপিয়রা নয়।
তৃতীয়ত এটাও আলোচিত হয়েছে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই বাংলায় যখন ব্রিটিশ পকড় সম্পূর্ণ হল, তখন থেকে বাংলার অর্থনীতি দ্রুতলয়ে পতন হতে শুরু করল। বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড কারিগরদের অবস্থার দুর্দশা শুরু হল। তাঁতি, চরকা কাটনি, রেশম কারিগর এবং অন্যান্য পেশাজীবিরা, যারা তাদের দক্ষতা কোন রকম চাপে এবং নিপীড়নের বাইরে দাঁড়িয়ে উতপাদনে বিনিয়োগ করতে পারত, পণ্য তৈরি করতে পারত, তারা কোম্পানির শাসনে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় দাসে পরিণত হল। এশিয় ব্যবসায়ীরা যারা রপ্তানি বাণিজ্যে এতদিন প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিল, তাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাংলার ব্যবসার অর্থনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। এর ফলে বাণিজ্য এবং শিল্প উভয়ের পতন ঘটল। অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে নবাবি শাসনে যে বাংলা সমৃদ্ধির চরম শিখরে উঠেছিল, সে পলাশীর পর অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে শুরু করল। কোম্পানি এবং তার আমলারা শাসন ক্ষমতা দখল নেওয়ায়, বাংলার অর্থনৈতিক দুর্গতির শুরু হল এবং বাংলার পরম্পরার ব্যবসা এবং শিল্পএর ধ্বংস সাধন ঘটল। এই সব ঘটনা একসঙ্গে মিলে উপবিংশ শতকের শুরুতে বাংলায় ডেকে আনল অবর্ননীয় ব্যপক দুর্দশা।
No comments:
Post a Comment