(ছবিতে হীরা বাঈ এবং আওরঙ্গজেব)
ঔরঙ্গজেবের ভাবনায় ন্যয় বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে বৃহত্তর ইসলামি প্রথা নির্ভর ছিল। এর সঙ্গে ধর্মতত্ত্বের কোন যোগ ছিল না। আধুনিকপূর্ব ইসলামে বিচারের ধারণাটা অনেকটা পারসি আর গ্রিক দর্শন থেকে আহৃত, যা কিন্তু মূলত ইসলামপূর্ব সময়। এই দৃষ্টিভঙ্গী যতটা আখলাক এবং আদাব(রাজনীতি এবং নৈতিক আচরণ)এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার, ততটাই আবার জিহাদ আর জিজিয়া(ধর্ম যুদ্ধ আর মাথট কর)র মত ধারণা থেকে দূরে অবস্থিত। এছাড়াও আওরঙ্গজেব তার সময়পূর্ব মুঘল সম্রাটদের বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং নিজেকে তাদের মত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আজ যাকে আমরা ন্যায় বিচার বলে যে বিষয়টাকে স্বীকার করি সেটা সেদিনের রাজা আওরঙ্গজেবেরর ধারণার সঙ্গে মিলবেই না। কিন্তু সেটাও এই বইতে আমার আলোচ্য নয়। আমি, আওরঙ্গজেবকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে বিচার না করে, শত শত বছরের যুক্তিহীন ধারণার নিচে লুকিয়ে থাকা আওরঙ্গজেবের জীবন আর শাসনকালকে নতুন করে আলোচনায় এনে, তার সময়ের প্রেক্ষিত তৈরি করার চেষ্টা করছি।
আওরঙ্গজেবের বিচার, ধর্মানুরাগ এবং মুঘল রাষ্ট্রের প্রতি নিষ্ঠার রেশ লুকিয়ে আছে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের পারস্যের ইতিহাস, সম্রাটের চিঠিপত্রএর মধ্যে। আওরঙ্গজেবকে বিচার করতে এই ফার্সি ভাষার পাঠগুলির মূলানুগ আলোচনা আমার লেখার হৃদিপক্ষ। এর সঙ্গে জুড়েছে হিন্দি, সংস্কৃত এবং অন্যান্য ভাষা(আরও বেশি জানতে পুস্তকতালিকা বিষয়ক প্রবন্ধ এবং পুনশ্চ দেখতে পারেন)র পাঠ। আওরঙ্গজেবের বিচারে নৈতিকতা এবং সহি ইসলামি ব্যবহার বলতে আমরা আজকে এইগুলি বিষয়কে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করি তার থেকে অনেকটাই আলাদা। আমাদের সামনে প্রশ্ন এটা নয় যে আওরঙ্গজেব নৈতিকতাপূর্ণ সম্রাট ছিলেন কি না। বরং আমি জানতে আগ্রহী আওরঙ্গজেব একজন নীতিনিষ্ঠ মুঘল রাজা বলতে কি বুঝতেন এবং কিভাবে তিনি হিন্দুস্থানের সম্রাট হওয়ার পরে তাঁর বিশ্বদৃষ্টি তৈরি করেন।
আওরঙ্গজেবকে তার দৃষ্টিভঙ্গীতে বোঝা দারুণ চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প হতে পারত, কিন্তু এতদিন তাঁকে সেইভাবে কেউ দেখার চেষ্টাই করেন নি। এই পদ্ধতিটি ধরে এগোলে আমরা মধ্যযুগের ভারতে আওরঙ্গজেবের প্রভাব এবং ইন্দো-মুসলমান ইতিহাসে তার অবস্থান সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারি। এছাড়াও সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য বহু সময়েই বর্তমান আওরঙ্গজেব, যা তিনি ছিলেন না, তাকে সেভাবে দেখানোর চেষ্টা করার অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ফানুষটার হাওয়া বের করে দিয়ে সেই তথ্যগুলিকে অকেজো করে দ্যায়। আওরঙ্গজেবকে নিয়ে আমি যা করতে চাই সেটা হল, তাঁকে নিয়ে বর্তমানে যে ব্যতিচার চলছে, সেই ভুল তথ্যগুলোকে সত্যিকারের ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করা। উল্টো দিকে আমার আগের চিন্তকেরা তার চলতি হাওয়ায় তৈরি হওয়া ছবিকে দুটি কৌশলে চাপা দেওয়ার যে চেষ্টা করেছেন সে দুটোই ব্যর্থ হয়েছে, কেননা সেগুলি ছিল রক্ষণাত্মক।
No comments:
Post a Comment