(ছবি - ১৮৫০ সালে - মৃত্যুর প্রায় ১৫০ বছর পর - আওরঙ্গজেরবের সমাধি)
বিভাজনকারী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে বাবর এবং তার উত্তরসূরী আওরঙ্গজেব একই স্তরের অত্যাচারী মুসলিম বিজয়ী। এই সূত্রে আওরঙ্গজেবের নাম “গোঁড়া মুসলমান”দের সঙ্গে এক বাক্যে উচ্চারিত হয়, যিনি ভারতএর অপ্রীতিকর অতীতের সঙ্গে একলপ্তে চিহ্নিত হন এবং বর্তমানে ভারতে তাই তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আকস্মিক নয় যে আওরঙ্গজেব আজকের ভারতে অন্যতম ধর্মপ্রাণ মুসলমান সম্রাট হিসেবে চিহ্নিত হন। তাই মোটামুটি অতীত এবং বর্তমানের লেখকদের নিরিখে আওরঙ্গজেব ধর্মান্ধ অত্যাচারী মুসলমান, যিনি তার ধর্মীয়তার জন্যে ভারতীয় সমাজকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দেন। এই ভাষ্যে ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দুত্ব একদেহী শিলায় লীন হয়ে বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়, অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীদের সমাজ বচ্ছিন্ন বলে মনে হয় এবং তাদের জন্যে শ্বাসরোধকারী অবস্থা তৈরি হয়।
একই সঙ্গে ভারতের অতীতের যে সব রাজা ঐতিহাসিকদের খুব কষে খিস্তি খেয়েছেন(reviled) আওরঙ্গজেব তাদের মধ্যেও অনাপ্সিত বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন। যে সব মানুষ বিজেপির মত হিন্দু সঙ্গঠনগুলির সঙ্গে একমতও নন, তারাও আওরঙ্গজেবকে অনুভূতিহীন কাষ্ঠনির্মিত সম্রাট হিসেবে চিহ্নিত করেন, যিনি ভারতীয়ত্বকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নামিয়ে এনে। সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানেও বহু মানুষ দুষ্কৃতি আওরঙ্গজেবের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা করেন। এমন কি তারা আজকের দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক সময়ে যে সব দুর্দশা ঘটেছে, তার জন্যেও আওরঙ্গজেবকে দায়ি করছেন। পাকিস্তানি নাট্যকার শাহিদ নাদিম সম্প্রতি বলেছেন, “আওরঙ্গজেবের হাতে দারা শিকোর হারেই আধুনিক সময়ের দেশভাগের বীজ রোপন করা হয়েছিল”। এই কষ্টকল্পিত ভাবনাটি হাস্যকর প্রমানিত হত, যদি না বহুমানুষ তাঁর ভাবনাকে সমর্থন করতেন।
পাকস্তানি নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গীটি তৈরি করে দিয়ে যান আধুনিক ভারতের রূপকার হিসেবে কথিত জবাহরলাল নেহরু। তিনি সরাসরি আওরঙ্গজেবের বিরোধিতাই করেছেন। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত ডিস্কভারি অব ইন্ডিয়ায় দীর্ঘ আলোচনায় আওরঙ্গজেবের অতিরঞ্জিত ত্রুটিগুলি উল্লেখ করে লিখছেন, a bigot and an austere puritan। তিনি ষষ্ঠ মুঘল পাদসাহকে বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়াশীল(throwback) হিসেবে চিহ্নিত করেন যিনি ঘড়ির কাঁটাকে সময়ের চলনের পিছনে চালাতে গিয়ে গোটা মুঘল সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করেন। মনেহয় নেহরুর আওরঙ্গজেবের প্রতি সব থেকে মানহানিকর উক্তিটা ছিল, তিনি এতটাই মুসলমান ছিলেন যে তার পক্ষে ভারতের সম্রাট হওয়া অসম্ভব ছিল When Aurungzeb began to oppose [অতীতের মুঘল শাসকদের সংশ্লেষী ধারা] and suppress it and to function more as a Moslem than an Indian ruler, the Mughal Empire began to break up। নেহরুর মতে আওরঙ্গজেবের ইসলামের প্রতি আনুগত্যই তাকে ভারতের শাসক হিসেবে অযোগ্য করে তুলেছিল।
আওরঙ্গজেব অতি বিপজ্জনকভাবে ধার্মিক ছিলেন, তাই তিনি খারাপ শাসক, নেহরুর এই মত তার নিজস্ব ছিল না। বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাততম, যদুনাথ সরকার আর তাঁর সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরাই নেহেরুর মত করেই ভেবেছেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিন্তকেরাও মুঘলদের বিরুদ্ধে বিপুল ধরণের অভিযোগ উপস্থাপন করেছেন - মুঘলেরা মেয়েলি, নিষ্ঠুর, নিপীড়ক এবং সর্বোপরি মুসলমান। ১৭৭২ সালে আলেকজান্ডার ডাও মুঘল সরকার সম্বন্ধে লিখলেন, the faith of Mahommed is peculiarly calculated for despotism; and it is one of the greatest causes which must fix for ever the duration of that species of government in the East। ব্রিটিশদের কাছে এই সমস্যার একটাই সমাধান ভারতে ব্রিটিশ শাসন। যদিও স্বাধীনতার লড়াই করা বহু নেতা এই দ্বিতীয় প্রস্তাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তারা ডাওএর প্রথম অংশটি নির্বিবাদে গলার্ধকরণ করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বৃহত্তর সমাজে পাঠ্যপুস্তক এবং গণমাধ্যম মার্ফত চারিয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহুকোটি মানুষ ঔরঙ্গজেবকে চেনেন ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে যিনি তার ধর্মান্ধতার বোঝা জনগণের অপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তাদের মননে এই ঔপনিবেশিক ধারণা নির্বিবাদে চর্বিতচর্বণ করে গিয়েছেন প্রখ্যাতরা।
No comments:
Post a Comment