(ছবি আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসে কোরাণ পড়ছেন)
আওরঙ্গজেবের শাসনের দ্বিতীয় শতকে আওরঙ্গজেব মুঘল রাজসিক প্রথা, চরিত্র তার মত করে পাল্টাতে শুরু করেন। হিন্দু ঐতিহ্যের কিছু প্রথা তিনি বাদ দেন এবং কিছু কিছু মানুষের যেমন গায়কদের দেওয়া রাষ্ট্রীয় সাহায্য বন্ধ করে দ্যান। তিনি দরবারের ঐতিহাসিকের পদ বিলুপ্ত করেন। এই পরিবর্তন হয়ত বাস্তবিক একটু উগ্রতার সৃষ্টি করল, কিন্তু সামগ্রিক মুঘল ঐতিহ্যের অন্য ক্ষেত্রে খুব বেশি হাত পড়ল না।
১৬৬৮ সালে আওরঙ্গজেব সরকারি পঞ্জিকার মুহম্মদ কাজিমকে নিয়োগ করলেন। তাঁর মুঘল প্রন্থাগার আর সরকারি মহাফেজখানায় যাওয়ার অনুমতি ছিল। মুঘল রাজারা সব সময় দরবারি ঐতিহাসিক নিয়োগ করতেন না; বাবর এবং জাহাঙ্গির স্মৃতিকথা নিজেরাই লিখেছেন আবার হুমায়ুনের ইতিহাসের অধিকাংশই তাঁর মৃত্যুর পরে লিখিত হয়েছে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের আমলের পূর্বের দুই গুরুত্বপূর্ণ পাদশাহ আকবর এবং শাহজাহান বেতন দিয়ে ঐতিহাসিক নিয়োগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব এই পরম্পরা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু মুহম্মদ কাজিমের আওরঙ্গজেবের প্রথম দশ বছরের শাসনের ইতিহাস, আলমগিরনামা পাওয়ার পর তিনি তাঁকে আবার ইতিহাস লিখতে নিয়োগ করেন।
দরবারি ঐতিহাসিকদের প্রতি আওরঙ্গজেবের বিতৃষ্ণা কেন জন্মেছিল তার কোন কারণ জানা যায় না। বহু ঐতিহাসিক এই ধাঁধাঁটার জট খুলে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন, কেন হঠাত আওরঙ্গজেব দরবারি ঐতিহাসিকদের অপছন্দ করা শুরু করেন। কেউ ভেবেছেন তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ের তুলনায় বাস্তবকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না বলেই হয়ত, বা সম্রাট হয়ত এতটাই ধার্মিক যে তিনি ধার্মিক লেখা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না, অথবা কেউ বলেছেন রাজস্ব বাঁচাবার জন্যে এই পদক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি। দরবারের ইতিহাসে এইসব তত্ত্বের কোন হাতে গরম প্রমান নেই। কিন্তু আওরঙ্গজেব আরেকজন দরবারি ঐতিহাসিক নিযুক্ত করেন নি, যদিও তিনি ঐতিহাসিক লেখা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন নি। বিংশ শতাব্দের কিছু জ্ঞানী পরের দিকের লিখিত ভুল ইতিহাসের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে এই বিষয়টা প্রমান করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সময়ে বিপুল পরিমান মুঘল আমলা ফারসি ভাষায় ইতিহাস লিখেছেন যা প্রকাশিত হয়েছে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে, সেগুলো আমরা আজ পড়তে পারি।
১৬৬০ সালের দশকে আওরঙ্গজেব দরবারি প্রথা সমূহের বেশ কিছু পরবর্তন আনেন। ১৬৬৯ সাল থেকে তিনি ঝরোখা দর্শন দেওয়া বন্ধ করে দ্যান। এই সময়ের শোনা যায় তিনি নিজেকে সোনা রূপোয় ওজন করে সেগুলো দুস্থদের মধ্যে বিলোবার প্রথা বন্ধ করে দ্যান। তিনি প্রকাশ্য দরবার থেকে থেকে গায়কদের সরিয়ে অন্য কাজে নিযুক্ত করেন(উল্লেখ্য অনেক বেশি বেতনে)।
তাঁর কিছু কিছু পদক্ষেপ খুব রাজনীতি সচেতনভাবে করা হয়েছে তা বলা যাবে না। বহুকালের মুঘল প্রথা ঝরোখা দর্শন বন্ধ করে দেওয়ার ফলে দেশ জুড়ে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা ঘটতে পারত। তিনি হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন, ১৬৫৭ সালে শাহজাহান মাত্র দশ দিনের জন্য অসুস্থ হয়ে ঝরোঝা দর্শন দেওয়া বন্ধ করে দিলে দাবানলের মত ভারতজুড়ে তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়া আটকানো যায় নি। মাত্র দশ দিনের অসুস্থতা ভারতের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণ হল।
প্রথম দফার তাঁর অনেকগুলি পদক্ষেপ বুদ্ধিমান রাজনৈতিকের মত নেন নি বলে আমাদের মনে হয়েছে। সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা, যতটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটল কাজের কাজ ততটা হল না। তিনি হয়ত সোনারূপো দিয়ে ওজন করার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন প্রথম দিকে ঠিকই মানসিকতার জন্যেই, পরে যদিও সে নীতি পাল্টান।
No comments:
Post a Comment