(ছবি - আজমেড়ে মৈনুদ্দিন চিস্তির দরবারে দুই পুত্র সহকারে আওরঙ্গজেব)
পঞ্চম অধ্যায়
নৈতিক মানুষ এবং নেতা
নৈতিক মানুষ এবং নেতা
ধার্মিকতা এবং শক্তি
সম্রাট তার প্রার্থনা একটি কাগজে লিখে বাড়তে থাকা বন্যার জলে ভাদিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্যার জল নামতে শুরু করল। সর্বশক্তিমানের আশ্রিত সম্রাটের প্রার্থনা সর্বশক্তিমান মঞ্জুর করলেন এবং বিশ্ব আগের গতিতে চলতে শুরু করল
– ভীমসেন সাক্সেনা, আওরঙ্গজেবের সেনা আমলার ফারসি ভাষায় লেখা পাঠ
সম্রাট তার প্রার্থনা একটি কাগজে লিখে বাড়তে থাকা বন্যার জলে ভাদিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্যার জল নামতে শুরু করল। সর্বশক্তিমানের আশ্রিত সম্রাটের প্রার্থনা সর্বশক্তিমান মঞ্জুর করলেন এবং বিশ্ব আগের গতিতে চলতে শুরু করল
– ভীমসেন সাক্সেনা, আওরঙ্গজেবের সেনা আমলার ফারসি ভাষায় লেখা পাঠ
অন্যান্য মুঘল শাসকের মত আওরঙ্গজেবও মুসলমান ধর্ম বিশ্বাস নিয়েই জন্মেছিলেন এবং উত্তরাধিকারসূত্রে সারা জীবন ধরে সেই ধর্মবিশ্বাস পালন করেছিলেন। বহু আগেই মৃত সম্রাটেদের মনের ভেতর ঢুকে ভাবনা জানা মুশকিল, কিন্তু, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমান থেকে এটা পরিষ্কার তঁর পূর্বজদের তুলনায় তিনি অনেক বেশ ধার্মিক ছিলেন। তিনি তার পূর্বজদের তুলনায় অনেক বেশি নিয়মিতভাবে প্রার্থনা করতেন, তিনি মদ্যপান করতে না অথবা আফিমের মত অন্যান্য নেশাদ্রব্যও গ্রহন করতেন না, যে নেশার কারণে তার বেশ কয়েকজন পূর্বজর মৃত্যু ঘটেছে। ১৬৬০ সালে আওরঙ্গজেব কোরান মুখস্থ করেন। সেই বছর থেকে তিনি নিজের হাতে কোরান নকল এবং প্রার্থনার টুপি সেলাই করার কাজ শুরু করেন।
কিন্তু আওরঙ্গজেবের ধার্মিকতা পালনের সঙ্গে ধর্মান্ধতার কোন যোগ নেই। আমরা অনেকেই জানি না, তিনি সারা জীবন বহু হিন্দু ধার্মিক গুরুর সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন তার পূর্বজদের মতই। ১৬৮০ সালে তিনি বৈরাগী শিব মঙ্গলদাস মহারাজের সঙ্গে ধর্ম আলোচনা করে তাঁকে উপহারে ভরিয়ে দ্যান। সম্রাটের সঙ্গে ইসলামি সুফি সমাজ – আরেকটি সময়-নিরপেক্ষ মুঘল ঐতিহ্য – যেমন মহারাষ্ট্রের চিস্তি কবর – তাদের সঙ্গে অসম্ভব নৈকট্য ছিল। আওরঙ্গজেব তার দুই সন্তান নিয়ে আজমেড়ে মুইনুদ্দিন চিস্ততির(মৃ ১২৩০) দরগায় শ্রদ্ধানিবেদন করতে যান ১৬৮০ নাগাদ। আওরঙ্গজেবের চরিত্রে জড়িয়ে থাকা ইসলামের এই চিত্রটি তার জীবনের স্তরগুলির বহুবর্ণিল অন্তর্তপাঠের সুযোগ করে দ্যায়। উদাহরণস্বরূপ তিনি একদা নিজের হাতে প্রার্থনা লিখে তার কাপড়ে সেলাই করে সেটি ব্যানারের মত করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাঠাতেন।
আওরঙ্গজেব তাঁর ধার্মিকতা– কখোনো তাঁর নিজের জন্যে, কখোনো পরার্থে সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করতে দ্বিধা করতেন না। উদাহরণস্বরূপ, সেলাই করা প্রার্থনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাঠানোকে তিনি জয়ের প্রতিরূপ হিসেবে দেখতেন। ভীমসেন সাক্সেনার সূত্রে জানতে পারছি তিনি কিভাবে তিনি হাতে লেখা প্রার্থনাপত্র লিখে বন্যার জলে ভাসিয়ে দিলে জল নেমে যায়। আরেক ঐতিহাসিকের লেখায় পাচ্ছি, কিভাবে আওরঙ্গজেব যুদ্ধের মাঝখানে যুদ্ধস্থলে দুই সৈন্যের মাঝখানে নেমে নিয়মিত প্রার্থনা করে তার সেনার মনোবল বাড়ান এবং নিজেকে সহি মুসলমানহিসেবে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন।
মুসলমান শাসক হসেবে তার ধার্মিক আদর্শ তার কাছে দাবি করছিল তার প্রজাদের জন্যে ন্যায় বিচারের মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রদান। নাতি আজিমুশ্বানকে লেখা চিঠিতে পাচ্ছি, ‘You should consider the protection of the subjects as the source of happiness in this world and the next’। কিন্তু মাঝেমধ্যেই প্রশাসনিক কাজ করতে গিয়ে কখোনো কখোনো সম্রাট ইসলামের সঙ্গে জনসংযোগের বিবাদ ঘনিয়ে ওঠার কোন এক অবস্থা দেখতে পেতেন। যখন এই দুটির মধ্যে বিবাদ চরমে উঠত তিনি রাষ্ট্রের হিতের স্বার্থে ধার্মিক বাধ্যবাধকতাকে বিসর্জন দিতেন, যদিও এই সিদ্ধান্তগুলি তার হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করত।
No comments:
Post a Comment