মধ্যযুগে ফারসি পাঠ্য বিষয়ে কিছু কথা
আওরঙ্গজেবের জীবন আর সময় বুঝতের বিভিন্ন বিপুল নথিপত্র বর্তমান। মূলত ফারসি ভাষায় লিখিত ইতিহাস, সাম্রাজ্যিক নির্দেশ, খবর, চিঠি, ভ্রমনকাহিনী ছাড়াও আরও বহু তথ্যাবলী মধ্যযুগের সম্রাটের জীবনপঞ্জী গড়ে তোলার জন্যে যথেষ্ট পরিমানে উপস্থিত। এই বিপুল পরিমান তথ্যাবলী থাকা সত্ত্বেও ইতিহাস তার প্রতি সুবিচার করে নি।
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে যে সব তথ্য আছে সেগুলি সব ঐতিহাসিকের কাছে সহজলভ্য নয়। বিপুল সংখ্যার পাণ্ডুলিপি ছাপাখানার মুখ দেখে না, মহাফেজখানায় বা গ্রন্থাগারে মুঘ গুঁজে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। এগুলি পড়তে গবেষকদের শুধু সময় বা অর্থ থাকাও যথেষ্ট নয়, দুটোই পর্যাপ্ত পরিমানে থাকতে হবে যাতে তিনি দক্ষিণ এশিয়া আর ইওরোপের নানান গ্রন্থাগারে ঘুরে সেগুলি অধ্যয়ন করতে পারেন। বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ছবিতোলা আজও নিষিদ্ধ বলে তাদের সংরক্ষিত তথ্যগুলির সম্পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারপরে আছে ভাষা শিক্ষা। আওরঙ্গজেব সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য, সে সময়ের দরবারি ভাষা ফারসিতে লিখিত, সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ প্রায় হয়নি বলা চলে। প্রয়োজনের তাগিদে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ফারসির মুল পাঠের না গিয়ে ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করেন। এর ফলে গ্রন্থাগার যাওয়ার সুযোগ কমে যায় ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ফারসি অনুবাদের গুণমানে প্রশ্নচিহ্ন লেগে গিয়েছে, ভুল অনুবাদের সঙ্গে রয়েছে সঙ্খিপ্তিকরণের রোগও এটাও মথায় রাখা দরকার। এই পরিবর্তনগুলি অনুবাদকদের রাজনৈতিক এজেন্ডা(উদ্দেশ্য)কে পুর্ন করার জন্যে করা হয়, বিশেষ করতে ঔপনিবেশিক অনুবাদকদের যারা দেখাতে চায় ইন্দো-মুসলমান সম্রাটেরা ব্রিটিশদের তুলনায় খুব খারাপ(এই তত্ত্বের প্রখ্যাত বই এলিয়ট এবং ডসনের হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া এজ টোল্ড বাই ওন হিস্টোরিয়ান্স)। এগুলি উপনিবেশের মননকে ন্যাংটো করে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দ্যায় ঠিকই, কিন্তু মুঘল ভারত সম্বন্ধে তীব্র অসত্য বচন প্রকাশ করে।
যদিও গবেষকেরা আওরঙ্গজেবের সময়ের তথ্যাবলি নিয়ে আজ ভালভাবেই কাজ করতে পারেন, কিন্তু এগুলির যথোপযুক্ত ব্যখ্যা করাটাই সমস্যার মুল ক্ষেত্র হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের সময়ের তথাকথিত গুরুত্বপুর্ণ ঐতিহাসিকদের মধ্যে কাফি খাঁ মুন্তাখাবুললুবাব এবং সাকি মুস্তায়েদ খাঁ মাসিরিআলমগিরি লেখা হয়েছে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর বেশ পরে এবং তারা সেই সময়ের নানান মানুষের স্মৃতি এবং শোনা ঘটনাকে নতুন করে উপস্থাপন করেছ্যেন পাঠকের সামনে। এই পদ্ধতি ইতিহাস ভাষ্যে অবশ্যম্ভাবী ভুলের সুযোগ তৈরি করে দেবে, যদিও তারা প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বয়ান তুলে ধরছেন। যদি সাম্রাজ্যিক নির্দেশ বা ফরমান বা চিঠি ইত্যাদিও গবেষকদের ভুলপথে এগিয়ে দিতে পারে, ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থিত করতে পারে। এবং আমরা দেখেছি, বহু ফরমান জারি হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে রূপায়িত হয় নি।
আর মধ্যযুগের অধিকাংশ লেখকই তথ্যের সত্যতা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না। আওরঙ্গজেবের সময় অতীতকে ভুলভাবে দেখা একটা স্বাভাবিক ক্রিয়া ছিল – যারা মনে করতেন তারিখ(ফারসিতে ইতিহাসের প্রায় প্রতিশব্দ) ইতিহাসের থেকেও বেশি সাহত্য রচনার প্রতি নিবিষ্ট থাকা অনেক নেশি জরুরি। তারা তাদের সাহিত্যিক লক্ষ্যপুরণ করতে ইতিহাসকে ব্যবহার করতেন, যেমন কাফি খাঁ যে ফুলেল ভাষায়, ব্যঙ্গের কষাঘাতে তার পছন্দ বা অপছন্দের এক ঘটনার তীব্রতা তাদের মত করে উপস্থিত করতেন। এই বিশেষ স্তরীভূত উতসাহের জন্যে সেই সময়ের ইতিহাসের ব্যাখ্যা আধুনিক কালের ইতিহাসের তুলনায় ন্যুন হয়ে যায় না, কিন্তু আমরা সেই কাজগুলি থেকে তথ্য আহরণ করার সময় সাবধান থাকব – তার সাহিত্যিক এবং একইসঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্য বিচার করে তৌল করে দেখব, কারণ মুঘল আমলের ইতিহাস দায়িত্বপুর্ণভাবে গঠন করতে আমাদের দ্বায়িত্ব সর্বাধিক।
অধিকাংশ আধুনিক ঐতিহাসিক ফারসি পাঠগুলির পাশাপাশি আধুনিকপূর্ব অন্যান্য ভাষার পাঠ বিশেষ করে ইওরোপিয় মুসাফিরদের লেখা, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার ইতিহাস এবং (খুব কম) সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি। এই সব কটি নিয়েও একই কথা বলা যায় যে সেগুলিতেও তথ্যের সঙ্গে মিথ ও গল্পকথা জুড়ে থাকে। ইওরোপিয় ভ্রমনকথাগুলি এ প্রসঙ্গে আলাদা করে বলা দরকার হয়, কারণ বহু মুঘল আমল নিয়ে কাজ করা গবেষক, এইগুলি নিয়ে বেশ বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন, এইগুলি কেন সোজাসাপতা ভাবে না বলে এগুলিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বিসেষ ধরণের পড়ুয়া(বিসেষ করে পুঁজিবাদী সমাজের)দের জন্যে।
আধুনিক ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক তথ্যকে খুব ভাল ওজন করে বিচার করে। তার মানে হল আমরা আমাদের ভাষ্যকে বৃহত্তর সামাজিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করব বিভিন্ন প্রমানকে কঠোরভাবে বিচার করে, এবং পাঠগুলিকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করেই। ঐতিহাসিকেরা আঁকা ছবি, প্রাসাদ বা টাকাকড়ির মধ্যেও তথ্য সন্ধান করেন। শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিকেরা প্রাথমিক পাঠ্যকে চরমভাবে তৈল করে একটি বৈধ ভাষ্য খাড়া করে যার মাধ্যমে ঐতিহাসিক চরিত্র, সংগঠন বা ঘটনার একটা প্রার্থিত বিশ্লেষণ উপস্থিত করে। ইতিহাস নিয়ে মতৈদ্বৈধতার প্রচুর অবকাশ আছে, এবং পালটা ভাষ্য বহু সময় আমাদের কোন কিছু নির্দিষ্ট গঠনমূলক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দ্যায়। কিন্তু আওরঙ্গজেব আর তার সময় নিয়ে ঐতিহাসিক সূত্র সংগ্রহ, বিচার এবং ঐতিহাসিক সত্যিকে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপন করা অততা জটিল নয়।
No comments:
Post a Comment