যদুনাথ সরকারের অনুবাদ
(ছবি - আওরঙ্গজেব শেষ বয়সে, ডুলিতে চড়ে)
(ছবি - আওরঙ্গজেব শেষ বয়সে, ডুলিতে চড়ে)
শেষ এই অবরোধে, দেবপুরে তাকে বিষম রোগে কাবু করে ফেলল। রোগ এতই বেড়ে গেল যে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছিলেন না। গোটা শিবির মুহ্যমান এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল – কিন্তু তার নির্দেশের অভাব ঘটল না। সকলেই ভাবছে কে তার নির্দেশগুলি পালন করবে। আর যদি সম্রাট মারা যান তাহলে কি হবে? সম্রাট হয়ত তার মৃত্যুর সময়টা ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি সব্বাইকে বাহাদুরপুরে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিলেন(৬ ডিসে ১৭০৫)। সেখান থেকে তিনি আহমদনগরে যাবেন ২০ জানু ১৭০৬ এবং তার এক বছর পর মৃত্যু বরণ করবেন।
আওরঙ্গজেবের শেষ বছরটি অবর্ণনীয়ভাবে অসহ্য রকমের দুঃখজনক। জনগণ বুঝছেন তার পঞ্চাশ বছরের গণবজীবন ব্যর্থতার কাহিনী। পঞ্চদশ লুইএর সেই অমর বাণী আমার পরে সব ধ্বংস আওরঙ্গজেবের কথাতেও প্রতিফলিত হয় আজ - ম-স্ত হামা ফাসাদইবাকি। তার ব্যক্তিগত জীবনও প্রেমহীন এবং বিষণ্ণতায় ভরপুর শেষ বয়সে শান্তির খোঁজ এবং আশাহীনতা তার চারপাশে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। অব্যক্ত নিঃসঙ্গতা শেষ জীবনে তার হৃদয়কে কুরে কুরে খেয়েছে। এক কন্যা জিনাতউন্নিসা শেষ বয়সে তার পিতার পাশে পাশে থেকেছেন। তার ছোটরানী উদয়পুরীও তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। তিনি একজন পুত্র ছাড়া প্রত্যেককে কারাগারে অন্তরীন করেছেন কোন না কোন সময়ে। তার নিজের যৌবনের কাজের ফলে তার জীবিতকালেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল, তিনি যেমন সিংহাসন দখল করতে শাহজাহানের প্রতি আচরণ করেছিলেন, তাঁর পুত্ররাও কি তাঁর প্রতি সেই আচরণ করবে? শেষ বয়সে সর্বশক্তিমানের মারের ভয়ে তিনি সারা জীবন পুত্রদের তাঁর কাছ থেকে দূরে রেখেছেন, পুত্রদের কাছে রেখে তিনি মনে শান্তি পেতেন না। যখন তিনি আঁখি মুদবেন তখন রক্তের বন্যা বইবে, এবং তার পুত্ররা বিভিন্ন সুবার সম্পদ আর সেনা বাহিনী অবলম্বন করে পরস্পরের বিরুদ্ধে তিক্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়েই তাঁর পুত্রদের পর পর দুটি চিঠিতে তিনি তার মানসিক কাঠিন্য ভেঙ্গে পড়ার ইঙ্গিত, উদয়পুরীর ভালবাসা, তার জীবনের ব্যর্থতা, এবং মুসলমানেদের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে তাদের জীবন নষ্ট না করার কথা বলে গিয়েছেন। শোনা যায় তাঁর মৃতুর পর তার বালিশের তলা থেকে একটি কাগজ পাওয়া যায় যেখানে তার তিন সন্তানের মধ্যে সাম্রাজ্য শান্তিপুর্ণভাবে ভাগ করে দেওয়ার ইচ্ছে লেখা ছিল। ইতোমধ্যে মৃত্যু তার পরিবারে আঘাত করছিল। আওরঙ্গজেবের শেষ জীবিত ভাই বোনের মধ্যে গৌহররা(মার্চ ১৭০৬) মারা যান। তার মৃত্যুও এগিয়ে আসছে বুঝতে পারছিলেন। তার কয়েকজন নাতি, ভাইপো এবং কন্যাকেও তার কাছ থেকে মৃত্যু ছিনিয়ে নেয় শেষ বছরটিতে। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে শুনতে তিনি এই হৃদরস্পর্শী কবিতাটা লেখেন
তুমি যখন ৮০ কি ৯০ বছরে পৌঁছবে
তখন সময়ের আঘাত তোমার জীবনে দেখতে পাবে
যখন তুমি একশ বছরে পৌঁছবে, তখন মৃত্যুর সঙ্গে জীবন মিলে যাবে
তখন সময়ের আঘাত তোমার জীবনে দেখতে পাবে
যখন তুমি একশ বছরে পৌঁছবে, তখন মৃত্যুর সঙ্গে জীবন মিলে যাবে
তিনি আরও লিখলেন –
এক মুহূর্তে, এক মিনিটে বা এক নিশ্বাসে
বিশ্বের অবস্থা বদলে যায়।
এক মুহূর্তে, এক মিনিটে বা এক নিশ্বাসে
বিশ্বের অবস্থা বদলে যায়।
No comments:
Post a Comment