দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, পরস্পরের ওপর নজরদারি করে ভারসাম্য
রাখার জন্যে কেন্দ্র থেকে বাংলা সুবায় যে আমলাদল পাঠানো হত, সেই নিয়মতান্ত্রিক
কাণ্ডটির ছেদ পড়ল ১৭১৩ সাল থেকে(J.N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol.II, p.410.)। দিল্লি থেকে আসা সুবাদার এবং দেওয়ানের সঙ্গে একদল আমলা
বাংলার প্রশাসনে আসত এবং তারা কেন্দ্রিয় সরকার আর সুবায় রাজ্য প্রশাসনের যোগসূত্র
হিসেবে কাজ করত। কিন্তু কেন্দ্র থেকে আমলা পাঠানোর প্রথার ছেদ ঘটায় কেন্দ্র
সরকারের সঙ্গে বাংলার যে স্বাভাবিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল শতকের প্রশাসনিক প্রথায়,
সেই যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ল। এরপর থেকে মুর্শিদকুলি বা তার উত্তরাধিকারীদের
মাথায় আর কোন উত্তরভারতীয় কেন্দ্র থেকে আসা আমলার জুড়ে বসার ঘটনা ঘটল না। সারা
ভারত জুড়ে যে অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলায় তার সরাসরি ফল
ফলল বাংলার প্রশাসন জোরদার হওয়ায়। বাংলার নিজামত আরও শক্তিশালী হল। বাংলার নবাবেরা
নিজেদের পছন্দ মতই আমলা নিয়োগ করতে শুরু করলেন মুঘল সাম্রাজ্য নিরপেক্ষ হয়ে তার
স্থানীয় স্তরে এবং নিজেদের পরিবার থেকেই। বাংলা শেষ পর্যন্ত যদিও মুঘল সুবার অংশ
হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল ঠিকই, ওপরের স্তরের প্রশাসনিক মাথাদের আর দিল্লির প্রতি
আনুগত্য দেখানোর দরকার পড়ল না। আমলারা বাংলার নাজিমকে কাজ বুঝিয়ে দিত এবং তার
নির্দেশেই কাজ করত। বছরের পর বছর ধরে এই কাণ্ড ঘটে চলায় নিজামের হাত শক্ত হল এবং
এর ফলে বাংলায় নতুন নিজামতের পত্তন ঘটল স্থানীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে।
বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা অন্যান্য এলাকার প্রশাসনিক
ব্যবস্থা থেকে অনেক আলাদা কারণ অধিকাংশ জমির দখল নিয়েছিল স্থানীয় ভিত্তিতে দেশিয়
জমিদারেরা। বছরের পর বছর রাজস্ব আদায় বাড়তে থাকায় এই জমিদারদের ভূমিকাও
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। জমিদারেরা স্থানীয় স্তরে রাজস্ব আদায় করতেন এবং শান্তি
শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। গুরুত্বপুর্ণ বড় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ করে প্রাদেশিক প্রশাসন
ছোট ছোট জমিদার সামন্ত এবং রায়ত/প্রজাদের পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করত। জমিদার আর রায়ত/চাষীদের
মধ্যে বহুস্তরীয় মধ্যস্থ ছিল। অধিকাংশ সময়েই জমিদারদের সংগৃহীত রাজস্ব নবাবের কাছে
পৌঁছত এই মধ্যস্থদের মাধ্যমেই। সপ্তদশ শতকে মনে হয় অধিকাংশ জমিদারই খুব ছোট আকারের
ছিল(James Grant, 'Finances of Bengal' in W.K. Firminger
(ed.), Fifth
Report, vol. II, pp. 176-91) এবং মুঘলদের
পক্ষেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শুরুতে
মুর্শিদকুলির রাজস্ব সংস্কারে বড় জমিদারদের আবির্ভাব ঘটল। এদের উদ্ভবে সুবায়
ক্ষমতার কাঠামোর কোন পরিবর্তনটা ঘটল সেটা আমরা খুব তাড়াতাড়ি দেখব।
দেওয়ান হিসেবে মুর্শিদকুলির নিযুক্তি বাংলার ইতিহাসে খুব বড়
বৈপ্লবিক ঘটনা। তিনি শুধু বাংলায় নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরিই করলেন না, তিনি
সামগ্রিক রাজনৈতিক বোধেও পরিবর্তন আনলেন। তার প্রশাসনিক ক্ষমতা পরীক্ষিত। তাই তাকে
সুচিন্তিতভাবেই আওরঙ্গজেবের পক্ষ থেকে বাংলায় পাঠানো হয়েছিল একটিই ছোট্ট নির্দেশ
দিয়ে, বাংলার রাজস্ব বাড়াও। মুঘল প্রশাসন বহুকাল ধরেই মনে করত বাংলা থেকে দীর্ঘকাল
ধরে কেন্দ্রিয় ভাণ্ডারে কম রাজস্ব যাচ্ছে এবং এই বাড়তি রাজস্ব লুটেপুটে খাচ্ছে
মনসবদার আর জমিদারেরা(Risala, f.8b; also quoted
in Calkins, 'Ruling Group', p.801)। রাজস্ব আদায়ের এই
পদ্ধতিতে বাংলার জমির দখলের পরিমানে এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন ঘটাল যেন তারা
একটা নতুন প্রাদেশিক গোষ্ঠীবদ্ধ হল(formation of a new,
regional group)। পরিবর্তনটিকে এইভাবে বলা
যায় emergence of big zamindaries with a consequent decline in the total number of zamindaries, the increasing importance of larger zamindaries in the political system of the province and the enhancement in the power of the moneylender and banking class (ঐ)।
No comments:
Post a Comment