Thursday, March 29, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২০ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে

সংস্কৃত – ভারতীয় আইন আর উপকথার ভাষা
ভারতে ব্রিটিশদের সংস্কৃত শিক্ষার দুটি মোদ্দা কারণের প্রথমটি হল প্রাথমিকভাবে প্রাচীন এই ভাষাটি জেনে, তাতে ঢুকে বৌদ্ধিক টহল দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাংলায় উপযুক্ত শাসন দেওয়ার পরিকল্পনা। হেস্টিংস তার পরিকল্পনা কোর্ট অব ডাইয়রেক্টর্সকে লিখে জানালেন এই পরিকল্পনায় বাংলায় কোম্পানির শাসন আরও মজবুত এবং ন্যায় পরায়ণ হয়ে উঠবে। পরিকল্পনাটির ভিত্তি ছিল, প্রিন্সিপলস অব এক্সপিরিয়েন্স এন্ড কমন অবজারভেশন, উইদাউট দ্য এডভান্টেজেস হুইচ এন ইনটিমেট নলেজ অব দ্য থিওরি অব ল মাইট হ্যাভ এফোর্ড আস। উই হ্যাভ এন্ডেভার্ড টু এডাপ্ট আওয়ার রেগুলেশনস টু দ্য ম্যানার্স এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিংস অব দ্য পিপল, এনড দ্য এক্সসিজেন্সিজ অব দ্য কান্ট্রি, এন্টারিং এজ ক্লোজলি এজ উই আর এবল টু দেয়ার এন্সিয়েন্ট ইউজেস এন্ড ইন্সটিটিশন।
হেস্টিংসের প্রকল্পের তাত্ত্বিক অবস্থান পরিষ্কার ছিল, ভারতীয়দের ভারতীয় নীতির দ্বারা শাসন করা দরকার, বিশেষ করে আইনএর দৃষ্টিতে। মুখ্য প্রশ্নটি ওঠে এই প্রাচীন ভাষা চর্চা এবং জ্ঞান অর্জন করে ব্রিটিশদের লাভ কি? প্রশ্নটা হেস্টিংসের কাছে খুব সোজা ছিল, সুদূর অতীত থেকেই হিন্দুদের কাছে অবিচ্ছিন্নভাবে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে এই আইনটা সংরক্ষিত রয়েছে, সেটিকে জানতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে। তিনি লিখলেন, এটি ভারতজুড়ে ব্রাহ্মণ বা আইনের অধ্যাপকেদের অধিকারে আছে, যারা বিভিন্ন দানে এবং জনসাধারণের পৃষ্ঠপোষকতায় বেঁচে থাকে। অধ্যাপকেরা প্রত্যেক মূর্তিপূজকের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। প্রত্যেক ফৌজদারি আদালতে কাজি, মুফতি এবং দুজন মৌলভি আইনের নিহিতার্থ প্রকাশ করে আভিযুক্ত কতটা দায়ি তা নির্নয় করেন। প্রত্যেক দেওয়ানি আদালতে উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতি এবং অন্যান্য ধর্মীয় কলহ মুসলমানেদের কোরানিয় আইনের দ্বারা আর জেন্টুদের ক্ষেত্রে শাস্ত্র ভিত্তি করে সাজা শোনানো হয়।
কোম্পানির মত বাণিজ্যিক সঙ্গঠনে দেওয়ানি আদালতের আইন জানা অনেক বেশি কাজ দেয় কেননা তাদের পরিচালিত দেওয়ানি আদালতের মুখ্য বিচারের বিষয়গুলিই হল ব্যক্তি বা পারমার্থিক সম্পত্তি বিবাদ, উত্তরাধিকারের আইন সংক্রান্ত বিবাদ, বিবাহ বা জাতি সংক্রান্ত বিবাদ, ধার সংক্রান্ত বিবাদ, হিসাব রাখার বিবাদ, চুক্তি খেলাপি, অংশিদারি ব্যবসা সংক্রান্ত বিবাদ এবং ভাড়া সংক্রান্ত বিবাদ মেটানো। এই পরিকল্পনা অনুসারে হেস্টিংস এবং অন্যান্য অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ অভিজাত চাইলেন কোম্পানি সরকার ভারতীয়দের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করুক দেশিয় আইনে বিচার দিতে।
এই পরিকল্পনা সফল করতে ব্রিটিশ জনগনকে হেস্টিংস বোঝালেন এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে প্রবাহমানতার ধারণা, বাস্তবতা আর তত্ত্বগুলি। ভারতের প্রাচীন সংবিধান দুটিভাগে বিভক্ত হিন্দু, মুসলমান। পণ্ডিতেরা মূলত অধ্যাপক, আবার কেউ কেউ আইনজ্ঞও বটে। আইন রূপায়নের জন্যে আছেন বিশেষজ্ঞ কাজি – বিচারক, যিনি বিচারের আইনগুলি কোথায় কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে সেটা জানেন। তাদের সাম্রাজ্যের আগে বাংলায় ছিল মুসলমান শাসন, ফলে ব্রিটিশেরা মনে করল সেই সময়ের ইসলামি ফৌজদারি আইনই দেশের আইন কিন্তু দেওয়ানি আইন পরিচালিত হবে হিন্দুদের জন্যে এক ধরণের আইন অনুসারে আর মুসলমানদের জন্যে আলাদা আইন অনুসারে। হেস্টিংস আর ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের আইন বিষয়ক এই সিদ্ধান্ত ভারতের বিচার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।
ব্রিটিশদের মনে হল, যদি হিন্দুদের জন্যে হিন্দু আধিকারিকের(পণ্ডিত) নেতৃত্বে হিন্দু আইন বলবত করতে হয় তা হলে হিন্দুদের নিয়ে একটি স্থায়ী সঙ্ঘ গঠন করা জরুরি, যারা তাদের সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারবে এবং সেগুলি ইংরেজিতে অনুবাদও করা যাবে, যাতে (ব্রিটিশ)বিচারপতি কি ধরণের বিচারে কি ধরণের রায় দিতে পারেন সেটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে।

No comments: