অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে
ধ্রুপদী প্রকল্প এবং ভারতীয় অভদ্র ভাষাগুলির সংজ্ঞা
জেন্টু কোডের অনুবাদক এবং বাংলায় প্রথম ব্যকরণ লেখক ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড তার
প্রায় সব কটি কাজের মূল স্তম্ভ হিসেবে অষ্টাদশ শতকের ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
সঙ্গে রোমিয়দের তুলনা টেনেছেন। বাংলার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন এবং তাকে
স্থিতিকরণের কাজে ব্যকরণ লেখার প্রকল্পটা একটা বড় হাতিয়ার। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড লিখলেন,
বাংলায় ব্রিটিশ কর্তাদের(ইংলিশ মাস্টারস অব বেঙ্গল) রোমিয়দের মত বাংলাতেও
স্বচ্ছন্দ হতে হবে, কেননা রোমিয়রা ছিল জ্ঞানে আর রুচিতে পিছিয়ে পড়া, এবং তারা গ্রিস
দখল করার পরেই নিজেদের যোগ্য করে তুলন। ঠিক তেমনিভাবেই ব্রিটিশদের বাংলাদেশে বাংলা
ভাষায় দখল নেওয়া দরকার যেহেতু এই ভাষাটি সরকার আর তার প্রজাদের মধ্যে, শাসক
ইওরোপিয়দের সঙ্গে দেশিয় শাসিতদের মধ্যে যোগাযোগের ভাষা যারা শাসকদের শাসন মাথা
নামিয়ে স্বীকার করবে। এর সঙ্গে ব্রিটিশদের মহানুভবভাবে শাসন করার জন্যে এবং আইন
প্রয়োগ করার জন্যে এই ভাষাটি জানা প্রয়োজন।
অষ্টাদশ শতকের বাংলায় ব্রিটিশেরা জটিল ভাষা বিভ্রাটে পড়েছিল। হাতেগোনা ব্রিটিশ
বাংলা জানত, অধিকাংশ ব্যবসায়িক কাজেকম্মে মুর ভাষা এবং পারসি ব্যবহার করত। এর থেকে
প্রমান হয় তাদের অধিকাংশ অধস্তন ভারতীয় কর্মচারী কি ধরণের ভাষা ব্যবহার করত।
১৭৯৯ থেকে ১৮০২ সালের মধ্যে ইংরেজি/বাংলা এবং বাংলা/ইংরেজি শব্দকোষ প্রকাশ করা
এইচ পি ফস্টার বাংলার আদালতে ফারসি ব্যবহারের একটা কল্পিত উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি
লিখছেন সমাজের এক্কেবারে নিম্নস্তরের অশিক্ষিত একজন ডোম দারোগার কাছে আভিযোগ দায়ের
করতে গিয়েছে। ফস্টার বলছেন দারোগার ফারসি জ্ঞান প্রাথমিকে পড়া কবুতরের গল্প
পর্যন্ত ছিল। ডোমটি অভদ্র(ভালগার) বাঙালি ভাষায় তার অভিযোগ দায়ের করে। দারোগাটি
ডোমের বাংলা ভাষা ভাঙ্গা ফারসিতে অনুবাদ করে ফারসি অক্ষরে আর কিছু ফারসি শব্দ বন্ধ
ব্যবহার করে নথিবদ্ধ করল। এই অভিযোগটি তারপরে ফারসিতে অনুবাদিত হয়ে নিজামত আদালত
পর্যন্ত যদি যাওয়ার সুযোগ হয় তবেই এটি ইংরেজিতে অনুদিত হবে। ফস্টারের যুক্তি,
বাংলার বিভিন্ন শহর যেমন ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং কলকাতার নিয়মিত বোলি বাংলা ভাষা
যদি ব্রিটিশ শেখে, তাহলে প্রজাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমটি আরও সরল হতে পারে।
উইলিয়াম কেরি দেখেছেন যে ব্যক্তিগত বা সরকারি ভৃত্যরা ইওরপিয়দের সঙ্গে কিন্তু
বাংলায় ভুলভাল ইংরেজি ফারসি আরবি আর পর্তুগিজ শব্দ মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলে। কেরি
দেশিয় ভ্রাতাদের সাবধান করে বলেছেন যে, সাধারণ দোভাষীরা কিছু মুর শব্দবন্ধ নির্ভর
করে সম্মানিত ভদ্রলোকেদের সঙ্গে কথা বলার কাজ চালিয়ে নেয় আবার সাধারণ মানুষের
সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে।
হ্যালহেড যে গ্রামারটা প্রকাশ করলেন সেটি সম্পূর্ণভাবে ইওরোপিয় ব্যকরণ তত্ত্ব
সঞ্জাত যেমন পার্টস অব স্পিচ, এলিমেন্টস এন্ড সান্সট্যান্টেটিভস, প্রোনাউনস,
ভার্বস, নিউমারালস, সিন্ট্যাক্স, অর্থোগ্রাফি এবং ভার্সিফিকেশনের অধ্যায় সাজিয়ে
তোলা। গর্বকরে বলেছেন, তিনিই প্রথম ইওরোপিয় যে বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতর মিলন ঘটাল
ফারসি এবং হিন্দুস্তানি শব্দগুলির বিচ্ছিন্ন করণ করে – দ্য ফলোয়িং ওয়ার্ক
প্রেজেন্টস দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মেরিলি এজ ডিরাইভড ফ্রম ইটস পেরেন্ট
স্যাংস্কৃট। তবে যারা সঠিক অনুবাদের পথ খুঁজছেন, তাদের অবশ্যই ফারসি আর
হিন্দুস্থানী বোলিগুলি পড়তে হবে, কেননা আধুনিককালের ব্যবসাবাণিজ্য আজকের অশিক্ষিত
প্রজন্মের হাতে এসে পড়েছে, তারা চিঠি লেখে হিসেব রাখে নকল করা শব্দবন্ধ দিয়ে এবং
অবৈধ বাক্য দিয়ে। হ্যালহেডের বাংলা ব্যকরণ জ্ঞানের দৌড় ছিল এক পণ্ডিতের সঙ্গে
সামান্য বাক্যালাপে যে তার সামনে ব্যকরণের সূত্রগুলি উন্মোচিত করেছে।
No comments:
Post a Comment