অধ্যায়২
ভাষার আধিপত্য আর আধিপত্যের ভাষা
কোম্পানি ভারতে ব্যবসা কর্ম শুরু করার সময় থেকেই ব্রিটিশেরা ভারতীয় শাসক মূলত মুঘলদের থেকে আইনি বৈধতা এবং নিরাপত্তা দাবি করেছে। এই লক্ষ্যে ১৬১৫ সালে টমাস রো কোম্পানি আর প্রথম জেমসের প্রতিনিধি হয়ে মুঘল দরবারে আসেন মূলত ব্যবসা করার অধিকার চাইতে এবং দুই রাজকীয় শক্তির মধ্যে দীর্ঘকালীন শান্তি এবং ভালবাসা বজায় রাখার বার্তা নিয়ে। রো ভারতের রাজনৈতিক বিশ্ব পা দিয়ে ভারতকে বোঝার চেষ্টা করলেন ইওরোপের মত করেই; বুঝলেন তাঁকে এই বিরুদ্ধ সভ্যতায় মানিয়ে নিতে হবে এবং মাথা নিচু করা আর ঘুষঘাস দেওয়া ছাড়া তার লক্ষ্য পূরণ হবে না। রো, রাজসভার ভাষা ফারসি জানতেন না, এবং কাউকে বিশ্বাস করে দেশ থেকে সম্রাট জাহাঙ্গীরকে সম্বোধন করে আনা প্রথম জেমসের চিঠি অনুবাদ করানো যায় এমন কাউকেই পেলেন না। রো তার চাকরিদাতাকে অনুযোগ করে লিখলেন, আমি আরও একটা সমস্যায় পড়েছি, আমারও কোন দোভাষী নেই। এখানে দালালেরা আমার আনা চিঠিগুলো বদলে দিতে পারে বলে আশংকা করছি কারণ আমার সম্রাটের নাম মুঘল সম্রাটের নামের আগে লেখা হয়েছে, এবং আমি এই পরিবর্তন ঘটানো এটা সহ্য করব না।
ভারতে থাকার সময় রো নানান ধরণের দোভাষী নিয়োগ করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের রাজসভা থেকে একজন গ্রিক, একজন আরমেনিয়, একজন নাকউঁচু ব্রিটিশ এবং এক সময় একজন ইতালিয় যিনি ফারসি নয় তুর্কিটা জানতেন এমন নানান দোভাষী ব্যভার করেছেন। ক্যারিবিয় অঞ্চলে থাকার সময় যে স্পানিশ শিখেছিলেন সেই ভাষায় তার শেষ দোভাষীর সঙ্গে কাজ চালানোর চেষ্টা করেছেন। ইতালিয় দোভাষীটি দরবারে তুর্কি আর ফারসি ভাষা জানা এক আমলার সাহায্যে রো’র ভাষ্য অনুবাদ করিয়ে নিতেন।
সপ্তদশ শতে ব্রিটিশেরা বুঝতে পারল, যদি মুঘল দরবারে তাদের কাজ করিয়ে নিতে হয়, তাহলে তাদের ফারসিটা শিখতেই হবে। ফারসিকে তারা কাজের ভাষা হিসেবে দেখে যা ব্যবহার করে তারা ভারতীয় আমলাদের সঙ্গে আলাপআলোচনা, অনুরোধউপরোধ, অক্ষমতা প্রকাশ ইত্যাদি করে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে। ফারসি জানা খুব উচ্চদরের জ্ঞানচর্চা, বিশেষ করে কাগজ নির্ভর মুঘল দরবারে যেখানে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জন্য নানান ধরণের আঙ্গিকে অনুরোধের বয়ান লিখতে হত। ফারসি, ভাষা হিসেবে, বৃহত্তর মানে ব্যবস্থাপনার(লার্জার সিস্টেম অব মিনিং) অংশ, যার ভিত্তি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির ধারণা ভিত্তিক ক্রিয়া। ভারতীয়রা যে আঙ্গিকে এবং শব্দের মানে ধরে ফারসিকে প্রয়োগ করত, ব্রিটিশ ইংরেজি সেই ভিত্তর থেকে শতযোজন দূরে অবস্থিত ছিল।
সপ্তদশ শতকে ইওরোপিয়রা মূলত স্বাক্ষর আর চিঠিচাপাটির ওপর নির্ভর করত, সেখানে ভারতীয়দের অবলম্বন ছিল ফলিতার্থ(সাবস্ট্যান্স)। রো’কে যে দরবারি প্রথায় প্রবেশ করতে হয়েছিল, তাকে তিনি অপকৃষ্টতা বলছেন, তিনি সেখানে স্বাভাবিকভাবে জুড়তে পারছেন না, যেখানে তিনি শাসকের বন্ধু হতে পারতেন।
No comments:
Post a Comment