অধ্যায়২
ভারতীয় ভাষা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গড়নের পথে
সংস্কৃত – ভারতীয় আইন আর উপকথার ভাষা
১৭৮৬সালের অক্টোবরে(অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই) জোনস (নিজের ঔপনিবেশিক হৃদয় সম্বল
করে) সংস্কৃত জ্ঞান সম্বল করে তার আদালতের পণ্ডিতদের স্মৃতিভাষ্য সংশোধনের কাজে
লেগে গেলেন। এবং মনুস্মৃতি অনুবাদের কাজ শুরু করে দিলেন। জোনস(বার্কের মতই) মনে
করতেন আদালতে হিন্দু মুসলমান বাঙ্গালি অনুবাদকেরা চরম দুর্নীতি পরায়ণ এবং তাদের
দুর্নীতিগ্রস্ত নিদানের হাত থেকে কুসুমমতি ব্রিটিশ বিচারকেদের মুক্তি প্রয়োজন। এক
দশক আগে ব্রিটিশেরা পার্সি ভাষায় জ্ঞান অবলম্বন করে যে রাজনৈতিক নথিপত্র পড়া আর
লেখার মাধ্যম হিসেবে আখুন্দ, মৌলভি এবং কায়স্থদের থেকে মুক্তির আশা করছিল, জোনস
সেই প্রকল্পকে আরও জোর ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দেবেন। জোনস তার হাতের কাছে থাকা হিন্দু
মুসলমান স্মৃতি শাস্ত্র থেকে একীভূত করে একটি সঙ্কলনের প্রস্তাব দিলেন এবং বললেন
সেগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ হলে ইওরোপিয় বিচারকেরা দেশিয় অনুবাদকদের নিগড় থেকে মুক্তি
পাবে। জোনস এমন একটা পদ্ধতি চাইছিলেন যার মাধ্যমে দেশিয়দের আইন অলঙ্ঘনীয় এবং
আদালতের নির্দেশ হিন্দু আর মুসলমান উভয়ের জন্যে পালনযোগ্য হবে।
যে পদ্ধতি জোনস অনুসরণ করতে চাইছিলেন, তা সংগঠিত করতে গেলে নানান ধরণের
জ্ঞানকে নথিকরণ করা এবং সেগুলি জনগণের কাজেও নিয়ে যাওয়া জরুরি কাজ ছিল। জোনস এবং অন্যান্য
আধিকারিক, পণ্ডিত এবং মৌলভির নেতৃত্বে হিন্দু এবং মুসলমান আইন একত্রিত করে
বিচারকদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। হিন্দু মুসলমান আইন বোঝার জন্যে একটা
জ্ঞানচর্চা সংঘ তৈরি করা জরুরি হয়ে উঠল। এই জ্ঞানী সংগঠন জ্ঞানের ক্রমোচ্চ শ্রেণী
বিভাগ করে এমন রায় দানের কাঠামো তৈরি করবেন, যেখানে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা
মানুষেরাও ন্যায় বিচার পাবে।
জোনস এবং অন্যান্যদের বিশ্বাস ছিল যে অতীত থেকে ভারতে ন্যায় প্রদানের আইন ছিল
এবং সেই ন্যায় দেওয়ার সংঘও ছিল যা সময়ের হস্তাবলেপনে এবং আকারে বৃদ্ধি পেতে পেতে
চরমতম দুর্ণীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশেরা মনে করল অতীতের মূল স্মৃতিশাস্ত্র বর্তমানের
স্মৃতিকারদের হাতে পড়ে টিকাকরণ এবং ব্যাখ্যা আর দুর্নীতির জঙ্গল হিসেবে গড়ে উঠেছে,
তাকে সেই পঙ্ক থেকে উদ্ধার করে অতীতের আকারে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। এবং একই সঙ্গে
তিনি মনে করতেন এই মূল শাস্ত্র কিন্তু টিকাকার ব্যাখ্যাকার পণ্ডিতদের কাছেই রাখা
আছে আর হিন্দু আর মুসলমান আইনকে পণ্ডিত ও মৌলভি অনুবাদকদের স্বৈরাচার থেকেও মুক্তি
দেওয়া জরুরি। কিন্তু মুশকিল হল এই কাজটি যে কোন প্রকারে সম্পন্ন হতে হবে অবিশ্বাসী
পণ্ডিত এবং মৌলভিদের অংশগ্রহণেই, যারা এই আইনের ব্যাখ্যার একচেটিয়া অধিকার নিয়ে রেখেছে।
ভারতে আসার আগেই জোনস ভারতীয় আইন বিষয়ক জ্ঞানী আর অনুবাদকদের পরম্পরাকে বিশ্বাস
করতেন না – সেই অবিশ্বাস ভারতে আসার পরে আরও বেড়েছিল। তিনি কর্নওয়ালিসকে ১৭৮৮ সালে
লিখলেন, সহজে আমি দেশিয় অনুবাদকদের নিদানকে বিশ্বাস করতে পারছি না কারণ তারা সব
সময়েই আদালতকে বিপথে পরিচালিত করতে চায়। জোনস ভারতে রাজা আর কোম্পানি পরিচালিত
ব্রিটিশ আদালত পরিকল্পনা পেশ করলেন, যা একমাত্র খাঁটি এবং বিশুদ্ধ হিন্দু
স্মৃতিশাস্ত্রের নিদান দেওয়ার ক্ষেত্রে উপযোগী সংঘ। তাহলে তার মতে পণ্ডিত ব্রাহ্মণ
এবং ভারতীয় ব্যবহারবিদদের হাতে হিন্দু আইনের যথেচ্ছ বিকৃতি সম্ভব হবে না।
হিন্দু আর মুসলিম আইনের একটি শাস্ত্র তৈরি করার উচ্চাশা ব্যক্ত করে জোনস
অতীতের রোমিয় পটভূমি আর ব্রিটিশদের এদেশে আগামী দিনে শাসনীয় প্রবাহমানতাকে জুড়লেন।
তার পরিকল্পনায় তিনি বললেন কিভাবে আইন প্রণেতা ট্রিবোনিয়ান বৈজ্ঞানিকভাবে শুধুই
মূল শাস্ত্র অবলম্বন করে জাস্টিনিয়ান কোড সংকলন করেছিলেন। তিনি বার বার বললেন আইনের
মূল কাঠামোটাই হল চুক্তিভিত্তি আর উত্তরাধিকারসূত্র এবং ব্যক্তিগত বাস্তব
সম্পত্তির অধিকার।
জোনস ভারতের ট্রিবোনিয়ন হওয়ার উচ্চাশার প্রকল্প বাস্তবায়িত করার সময় পর্যন্ত বেঁচে
ছিলেন না। আজও তিনি কোর্ট অব ডিরেক্টর্সদের দেওয়া সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের প্রাঙ্গনে
টোগা পরিহিত মুর্তি হয়ে হাতে কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রোমানিয় অতীতের ব্রিটিশিয়
অবশেষ আজও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখা যায় যেখানে রোমান সেনেটারের অনুকরণে টোগা
পরিহিত ওয়ারেন হেস্টিংস দাঁড়িয়ে আছেন, যার নিচে দাঁরীয়েয়াছেন একজন তালপাতার
পাণ্ডুলিপি হাতে ব্রাহ্মণ এবং ফারসি পুথি হাতে মৌলভি।
No comments:
Post a Comment