উনবিংশ শতে ভারত ব্রিটেন আর ফ্রান্স
এই প্রেক্ষিতে লর্ড মর্নিংটন ওরফে রিচার্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৭
সালে ভারতীয় উপমহাদেশের কোম্পানি সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা, গভর্নর জেনারেল রূপে
মনোনীত হলেন। ওয়েলেসলি তাত্ত্বিকভাবে সরাসরি মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থক, আইরিশ
অভিজাত, ভাই আর্থার ওয়েলেসলি ভবিষ্যতের ডিউক অব ওয়েলিংটন হবেন এবং ফরাসী বিপ্লবের
প্রতি বিরুপ বার্কের তাত্ত্বিকতার অনুগামী। যেহেতু তিনি কোম্পানির বোর্ড অব কন্ট্রোলের
সদস্য ছিলেন, ভারতের সে সময়ের অবস্থা আর ফরাসীদের মনোভাব সম্বন্ধেও তিনি সম্পূর্ণ
অবহিত ছিলেন।
১৭৯৮ সালে উপনিবেশের রাজনীতি পৌঁছতে না পৌঁছতেই নতুন গভর্নর
জেনারেলের টেবলে স্থানীয় খবর কাগজগুলো থেকে একটা খবর পৌঁছল নেপোলিয়ানের নেতৃত্বে
ফরাসীরা মিশর হয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তিনি আরও জানলেন মালাবার উপকূলে ফরাসী
আর তাদের বন্ধু টিপু সুলতান যৌথভাবে উপমহাদেশের ব্রিটিশ স্বার্থে ঘা দেওয়ার
পরিকল্পনা ছকছে। কলকাতার একটা খবরের কাগজ সূত্রে জানা গেল আজকের মরিসাস(Isle de France)এর গভর্নর Anne Joseph Hyppolite Malartic টিপু আর ফরাসীদের মধ্যে সন্ধি করে ফরাসি নাগরিকদের টিপুর
সেনা বাহিনীতে স্বেচ্ছাব্রতের ডাক দিয়েছেন। একইভাবে জানলেন নিজাম শাসিত
হায়দ্রাবাদে ১৪০০০ ফরাসী সেনা উপস্থিতির খবর।
১৭৯৮ সালের ২৬ন নভেম্বর কোম্পানির গোপন কমিটি তাকে
নেপোলিয়নের মিশর দখলের সংবাদ পাঠাল লন্ডন থেকে। নীল নদের যুদ্ধে নেলসনের বাহিনীর
জয় সত্ত্বেও ১৯ এপ্রিল ১৭৯৯ সালের এক ডেসপ্যাচে কোম্পানি ওয়েলেসলিকে জানাল তিনি
প্রয়োজনে ভারতীয় ব্রিগেড নিয়ে লোহিত সমুদ্র মার্ফত নেপোলিয়নকে আক্রমণ করে চমকে
দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
ওয়েলেসলি দেরি করেন নি। সম্ভাব্য ভারত আক্রমণ রুখতে তিনি ৩
হাজার সেনা মিশরে পাঠালেন। পারস্য উপসাগরের বুশহরের কোম্পানির রেসিডেন্ট মেহদি আলি
খান এবং জন ম্যালকমকে পারস্যের শাহের কাছে পাঠিয়ে ফরাসীদের ভারত আক্রমণের কোন
সম্ভাবনায় তাঁর সাহায্যের প্রার্থনা জানিয়ে রাখলেন। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে
হায়দ্রাবাদে সেনাবাহিণী পাঠিয়ে অবাক ফরাসীদের হারিয়ে দিয়ে গোটা সেনাবাহিনীকে বন্দী
করলেন। রাণীর ৩৩তম পদাতিক বাহিনীর সেনানায়ক, ভাই কর্নেল আর্থার ওয়েলেসলিকে সেনাপতি
জর্জ হ্যারিসের নেতৃত্বে ফরাসীদের যে কোন রকম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রুখতে দায়িত্ব
দিলেন। হায়দ্রাবাদের নিজামের বাহিনীর সহায়তায় বিপুল ইংরেজ সেনাবাহিনী মহীশূর
আক্রমণ করে ১৭৯৯ সালের মার্চ মাসে। শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে টিপুর মৃত্যু হলে
ভারতে ফরাসীদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মহীশূরের পূর্ববর্তী
রাজার নাবালক সন্তানকে সিংহাসনে বসিয়ে টিপুর অর্ধেক রাজ্য গ্রাস করে ইংরেজ।
বলপ্রয়োগে ফরাসীদের হারাবার পর ওয়েলেসলি কলকাতার রাজধানীতে
বসে বৌদ্ধিক বিজয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। প্রথমেই এল খবর কাগজের ওপর নজরদারি। তারপর
ভারতে সরকারিভাবে থাকা প্রত্যেক ইওরোপিয়র জন্যে বাধ্যতামূলক ভিসা বলবত হল। কিন্তু
ব্রিটিশ কোম্পানির যুবা আমলারা স্বাভাবিকভাবেই ফরাসী বিপ্লবের সাম্যের ডাকে কিছুটা
হলেও প্রভাবিত হতে পারেন এমন আশংকা করে, এই প্রথম কোম্পানির চরিত্রে বদল আনার
চেষ্টা করলেন ওয়েলেসলি। কোম্পানিকে শুধু একটি কর্পোরেট সওদাগর থেকে ভারতের
প্রশাসনিক শাসকে রূপান্তরিত করার উদ্যম নিলেন।
No comments:
Post a Comment