অধ্যায়২
ভাষার আধিপত্য আর
আধিপত্যের ভাষা
ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি যে সব নথিপত্র তৈরি করেছে যেমন দ্য লেটার্স রিসিভড ফ্রম ইটস সার্ভ্যান্টস
ইন দ্য ইস্ট বা দ্য ফোর্ট উইলিয়াম-ইন্ডিয়া হৌস করেসপন্ডেন্স এবং ভারতের
মহাফেজখানাগুলো যেমন ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়া বা ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে যে
সব তথ্যনির্ভর পাণ্ডুলিপি রয়েছে, সেগুলি নির্ভর করে সাধারণত ঐতিহাসিকেরা ভারতে
ব্রিটিশ আধিপত্য এবং উপনিবেশিক তত্ত্ব আর সংগঠনগুলির স্থাপন আর বেড়ে ওঠার গল্প লেখেন।
মহাফেজখানাগুলোতে যে সব নথি রক্ষিত আছে, সেটি কয়েকশ বছর ধরে বিপুল সংখ্যক কোম্পানি
আমলার পরিশ্রমে(কোহন ব্যবহার করেছেন ট্রিবিউট শব্দটি) গড়ে উঠেছে। ওয়েবস্টার
কলেজিয়েট ডিক্সনারি(১৯৪৮)তে ট্রিবিউটের অন্য একটা মানে করেছে, ‘আ পেমেন্ট পেইড বাই
ওয়ান রুলার অর নেশন টু এনাদার, আয়দার এজ এন একনলেজমেন্ট অব সাবমিশন, অর অব দ্য
প্রাইস অব প্রোটেকশন’।
এই প্রবন্ধে আমি বলব
ছাপা অক্ষরে যে ট্রিবিউট তৈরি হয়েছে, তা আদতে ভারতীয়দের তৈরি এক জটিল এবং বিষম জ্ঞানচর্চা
ভাণ্ডার, যেটি ইওরোপিয়রা নথিকৃত, সংহত এবং প্রচার করে। ভারতাধিকার আদতে উপমহাদেশিয়
জ্ঞানের ওপর অধিকার। এই বিস্তৃত সরকারি সূত্র ধরে আমরা দেখব জ্ঞানের পরিবর্তিত রূপটি
কি দাঁড়াল। একই সঙ্গে এটাও দেখব কিভাবে দখলদারেরা তাদের উদ্দেশ্যপূরণে কোন জ্ঞান
ব্যবহারযোগ্য (ইউজফুল) সেটা দেগে দিল। সপ্তদশ এবং অষ্টদশ শতে কোম্পানির মূল ভাবনা
ছিল সওদাগরি বাণিজ্য, যেখানে আমরা পণ্যের তালিকা, দাম, বাণিজ্য পথ বিষয়ে তথ্য, উপকূলীয়
এবং আভ্যন্তরীণ বাজার আর মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কে রাজনৈতিক নানান তথ্য বিশেষ করে
কোম্পানির কাজকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা মোঘল সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসনের
আমলাদের কাজকর্ম ইত্যাদি। এই পাণ্ডুলিপিতে আবদ্ধ নানান তথ্যের মধ্যে ছড়িয়ে আছে
কোম্পানিতে কর্মরত বা তার সঙ্গে যুক্ত ভারতীয়র নাম ধাম যাদের জ্ঞান আর তথ্য, যা
অবলম্বন করে এদেশে তারা বাণিজ্য কর্ম সাধন করতেন।
এই আমলাদের
ব্রিটিশিয় লব্জে নামগুলির মধ্যে কয়েকটি হল আখুন্দ, বানিয়ান, দালাল, দুবাশি, গোমস্তা,
পণ্ডিত, স্রফ এবং উকিল(ভকিল)। কোম্পানির আঞ্চলিক কুঠির অবস্থান অবলম্বন করে এই
উপাধিগুলি হয়ত পরিবর্তিত হত, কিন্তু এই উপাধিধারী ভারতীয়রা আদতে বিশেষ জ্ঞানে
জ্ঞানী ছিলেন, কেউ বাজারের দামে বিশেষজ্ঞ, কেউ মুদ্রার মূল্যমান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বিশেষ
ধরণের পণ্যের উতপাদনস্থল বিষয়ে জ্ঞানী, কেউ বা বাজারের আঞ্চলিতা বিষয়ে জ্ঞানী, বিভিন্ন
প্রবাহশীল বাণিজ্য পণ্যের বাণিজ্য শৃঙ্খল বিষয়ে জ্ঞানী, কেউ কেউ সাম্রাজ্যের
স্থানীয় প্রশাসনে বিশেষজ্ঞ, কেউ কেউ দৌত্য বা সামগ্রিক রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানী,
কেউবা শাসকদের চরিত্রসম্বন্ধে নিখুঁত ধারণা পেশ করতেন – এই সকল ধরণের মানুষের সফল
কাজের ওপর ব্রিটিশদের বাণিজ্য নিরাপত্তা নির্ভর করত। এই জ্ঞানীরা বহুবোলি ছিলেন, বিভিন্নস্তরে
কাজ করা দেশি বিদেশি মানুষের বাণিজ্যের জন্যে তৈরি উপযুক্ত ভাষা বলতে পারতেন।
করমণ্ডল উপকূলের
দুবাসি তাদের উপাধি অনুযায়ী কাজ করতেন, যার অর্থ দ্বিভাষী – দুটি ভাষা জানতেন। বাংলায়
আখুন্দ উপাধিধারীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে মুসলমান বিদ্যালয় শিক্ষক যাদের কাজ ছিল
ফারসি ভাষায় লিঠি লেখা এবং সেই ভাষায় আসা চিঠির মর্মোদ্ধার। আখুন্দেরা বিভিন্ন
দৌত্যের কাজে নিযুক্ত হতেন এবং মুঘল দরবারে বিভিন্ন স্তরের আমলাকে চিঠি দেওয়ার কাজ
করতেন। আখুন্দদের মতই উকিল বা ভকিলেরাও ভারতীয় ব্রিটিশপূর্ব প্রশাসনের সঙ্গে দরাদরি
করতেন। তারা শুধু্ ফারসি ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞানী ছিলেন তাই নয় দরবারি নানান প্রথা
এবং ব্যক্তিত্বদের সম্বন্ধেও সম্যক পরিচিত ছিলেন। তারা মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে
কোম্পানির নানান আইনি এবং ব্যবসায়িক দরকষাকষি নিয়ে আমলাদের পথ দেখাতেন।
১৬৭০এর দশকের সুরাটে
শিবাজীর সঙ্গে কোম্পানি বিভিন্ন স্তরে আলাপআলোচনা করছিল। বিষয় ছিল কোম্পানির
রাজাপুরের মত কয়েকটি কুঠিতে শিবাজীর সেনার আক্রমনের ক্ষতিপূরণ বিষয়ক দাবি আর শিবাজীর
অধিকারে থাকা এলাকায় বাণিজ্যাধিকার অর্জন। এই সময়ে বেশ কিছু ভারতীয় বিশেষ করে
পর্তুগিজ কেরানী রামা সেনাভি এবং কোম্পানির ভাষাবিদ নারায়ণ সেনাভি নামে দুই ভাই,
কোম্পানির এই দাবির সপক্ষে সফলভাবে শিবাজীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কোম্পানির দাবি
আদায় করে।
No comments:
Post a Comment