Thursday, March 1, 2018

উপনিবেশ বিরোধী জ্ঞানচর্চা - ক্ষমতা হারানোর ব্যথা

অসুর আর সাঁওতাল দুটি সম্পূর্ণ আলাদা সমাজ। সাঁওতাল সমাজে হুদুরদুর্গার গল্প আছে সেটি অনেকেই জানি, নেট খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে - সেটি ক্ষমতা হারানোর গল্প - বেশ জোরালোও বটে - দাঁসাই নাচ এর একটি সাংস্কৃতিক প্রকাশ। তথাকথিতভাবে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী যাঁদের জনজাতি বা উপজাতি বলে(কেন?), তাদের এক করে দেখার প্রবণতা আছে - প্রত্যেকের আচার, সমাজ বন্ধন, কৃষ্টি, সমাজ গড়ে ওঠার গল্প, কিন্তু আলাদা আলাদা। কিন্তু অনআদিবাসী সমাজ এদের নানান বিষয়কে এক করে দেখতে পছন্দ করি। ঠিক যেমন আম মধ্যভদ্রবিত্ত বাঙালী, পাশের ঘরের নেপালী, জাপানী, চিনা বা অন্যান্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানুষকে এক নজরে খুব বেশি আলাদা করতে পারে না। এঁরা খুব পুরোনো ধাতুবিদ - গোন্দ এলাকার বাস্তারর অবুঝমাড় ইত্যাদি খনি অঞ্চলে এ ধরণের প্রচুর সমাজ আছে - দাক্ষিণাত্যে ছিল উত্তরপূর্বে ছিল। পূর্ব ভারতে সাঁওতাল আর অসুর দুটো সম্প্রদায়ই কিন্তু লোহার কাজে মাহির ছিল। সাঁওতালেরা এখন ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু বাংলা জুড়ে থাকা অসুরেরা আজও যে লোহা তৈরি করেন তাতে জং পড়ে না।
হীতেশ রঞ্জন সান্যাল এবং আরও অনেক ব্রিটিশ জ্ঞানচোর লিখে গিয়েছেন সাঁওতাল সমাজের লোহা গলানোর দক্ষতার কথা। কিন্তু তাঁরা অস্ত্র বা তৈজস তৈরি করতেন না। এই কাজটি করতেন কামারেরা। তাঁদের গ্রামের বাইরে এনে বসাতেন সাঁওতাল সমাজ। যে লোহা গলিয়ে তাঁরা বাট তৈরি করতেন তা নিয়ে কামারেরা নানান ধরণের দ্রব্য তৈরি করতেন। তাঁর একটা বড় হিসেব দিয়েছেন সান্যাল মশাই। ১৯০৯ সালে এডূইন রায় ওয়াটসন বাংলার লোহা শিল্প নিয়ে একটা ছোট্ট বই লেখেন - যার গড়ন মোনোগ্রাফএর। সূত্র https://archive.org/details/monographonirons00watsrich
তো আমার ধারণা এই বিতর্কে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ক্ষমতা হারানোর ব্যথা। বাংলায় শুধু নয়, অসুর, ঘোষ, বিশ্বাস, পোদ, হাড়ি, বাগদি, সাঁওতাল, পটুয়া(যাদের নাম ছিল মষ্করী - যারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মহাযানী গুম্ফায় চিত্রগুলি তৈরি করেছেন, আজও করেন উত্তরবঙ্গের পেদঙ্গের গুম্ফায় কয়েক বছর আগে করেছেন), ব্যবসায়ী, নাথ বৈদ্যক সহ হাজারো সমাজ একসময় পূর্ব ভারতের উৎপাদন-বিতরণ, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সূত্র ছিলেন - পালেদের সময় লড়াই করেছেন ভীম-দিব্যোক কৈবর্তরা - সেই পালেরা আজকের মাটি ছানা পাল নয় অন্য কিছু ছিলেন(তাই সেই সময়কে মধ্যবিত্ত ঐতিহাসিকরা দাগিয়ে দিলাম মাতস্যন্যায় বলে) - বৌদ্ধ রাজা রূপা বাগদীর নাম নিয়েছেন বেনের মেয়ে উপন্যাসে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী - ধর্মমঙ্গলে ডোম কন্যারা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করেছেন - আগডুম বাগডুম ঘোড়া ডুম তো ডোমেদের নিয়ে স্পর্ধাগীতি।
এঁরা সক্কলে মিলে এই পূর্ব ভারতের কৃষি আর শিল্প ভিত্তিক সভ্যতাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন নিজেদের মত করে - তাই দ্বারভাঙ্গা ছিল বঙ্গএর দ্বার - তার পর ম্লেচ্ছদের যায়গা, যোনিস্থান - আর ছিল প্রযুক্তির জ্ঞানচর্চা তন্ত্রবিদ্যা - তার সঙ্গে বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থা ধাতুবিদ্যা রসায়ন বিদ্যার বিশেষ যোগ ছিল - যা পাই ভগভট্টের রসরত্নসমুচ্চয় সহ প্রচুর জ্ঞানচর্চায় - আমরা এদের এলকেমিস্ট বলে দেগে দিয়েছি।
তাই শুধু বাংলা নয় পূর্ব ভারত ছিল শূদ্র ভারত। পাটনা মানে চম্পার আর্যভট - পৈতে পরা ভট্ট নয় - তাহলেই ব্রাহ্মণ হবেন, ভট হলে দাস বা নিচু শ্রেণীর সেনানী - তিনি অসাধারন কাজ করে গিয়েছেন -তাঁর কাজের রেশ বছর গড়িয়ে ভারত জুড়ে ক্ষুদ্রতম-বৃহততম অঙ্কের জ্ঞানচর্চা গড়ে উঠেছে, অন্ধ্র কেরলে লিমিট ছাড়া কলনবিদ্যার বিকাশ ঘটেছে পুতুমানা সোমাইয়া ইত্যাদি মানুষের কাজে - এই কয়েকশ বছর আগেও তা চার্লস উইশের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে - তাঁর মত অন্যান্য শুদ্ররা যে সভ্যতা তৈরি করেছেন জ্ঞানে প্রযুক্তিতে দক্ষতায় - তার বলে ১৮০০ সালের আগে পর্যন্ত পূর্ব ভারত বিপুল ব্যবসা করত সারা বিশ্বে - এ নিয়ে আমাদের দীনেশ সেন বা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রচুর কাজ করে গিয়েছেন - নতুন করে বলা বাহুল্যমাত্র - যেমন এই লোহা আর ক্রুসিবল ইস্পাত যেত দামাস্কাসে।
সমস্যা হল এই মানুষেরা ক্ষমতা হারালেন, উৎপাদন ব্যবস্থা হারালেন, নিজেদের সমাজ ধ্বংস হওয়া দেখলেন চোখের সামনে - সমাজের জমি সম্পদ জ্ঞানচর্চার পরিবেশ কেড়ে নিয়ে বিশিল্পিয়ায়ন করল ব্রিটিশ আর কর্পোরেট মধ্যবিত্ত যৌথ উদ্যম - লড়াই করলেন - পারলেন না - আর তার রেশ তাদের সংস্কৃতিতে পড়ল।
এক পক্ষের সব হারানো বা অন্য পক্ষের ধারের সভ্যতা গড়ার রূপ হয়ত দুর্গা পুজো। এ নিয়ে আমাদের কথা বলা সাজে না। গুণীরা বলুন।

No comments: