Wednesday, March 28, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৫ - ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন

অধ্যায়২
ভাষার আধিপত্য আর আধিপত্যের ভাষা
ব্রিটিশেরা যেভাবে ভারতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করত, তাতে ভাষা শেখার একটা প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই তার সঙ্গে যুক্ত হল ভারতীয় সংস্কৃতিতে যুক্ত না হওয়ার তাদের মানসিক বাধা। সপ্তদশ শতকের মাঝখান থেকে অষ্টদশ শতকের মধ্যিখানের সময় পর্যন্ত ভারতে কোম্পানির হাতে গোণা চুক্তিবদ্ধ আমলা ছিল। ১৭৪০ সালে ১৭০, ১৭৫৬য় পলাশীর আগের সময় পর্যন্ত ২২৪ জন। অধিকাংশ আমলাই বন্দর শহর আর উপকূলে মূলত তাদের কুঠির আশেপাশে বাস করত। তাদের যোগাযোগের ঘেরাটোপ ছিল মূলত ইওরোপিয় সমাজ। কোম্পানির ভারতীয় গৃহভৃত্য বা দপ্তরভৃত্যরা কিছু বাণিজ্য(পিজিন) ইংরেজি আর পর্তুগিজ জানত – যে দুটো আদতে উপকূলীয় বাণিজ্য ভাষা হিসেবে মান্য ছিল। অধিকাংশ ব্রিটিশ মনে করত যে তারা এই দুটি ভাষার সঙ্গে আর কিছু স্থানীয়, তাদের ভাষায় মুর ভাষা ব্যবহার করেই কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। তাই ভাষা ভাল জানত না বলে অধিকাংশ কোম্পানি আমলা খুব কম দিনই ভারতে চাকরিতে থাকত – কোম্পানির নিয়মে খুব বেশি হলে পাঁচ বছর তারপরে ইংলন্ডে ফিরে যেত। কেউ অসুখে বা সেনা বাহিনীতে কাজ করতে গিয়ে মারা যেত। মূলত পর্তুগিজ এবং ভারতে জন্মানো ইওরোপিয়রাই ভারতীয় ভাষা জানত এবং বলতেও পারত। এদের অধিকাংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিচের স্তরে কাজ করত এবং তার সঙ্গে ছোটখাট ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করত। কোম্পয়ানি কর্তারা এদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। কর্তারা মনে করত নিচুস্তরের কোম্পানি ভৃত্যরা খুব বেশি বিশ্বাসের পাত্র নয় এবং নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ, কোম্পানির স্বার্থের কাছে জলাঞ্জলি দেবে না।
১৭১৩ সালে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে শুল্ক কম করার জন্যে এবং তাদের ব্যবসার প্রথম সময় থেকে পাওয়া নানান ধরণের সুবিধে একসঙ্গে করে একটা স্থায়ী ফরমান পাওয়ার চেষ্টা করছিল, সে সময় বাংলায় এই দরকষাকষির কাজটি করার জন্য ফারসি ভাষা জানা কোন ব্যক্তিকে তারা জোগাড় করে উঠতে পারে নি। ফলে তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে আরমেনিয় বণিকের স্বারস্থ হতে হয়। দোভাষীকে নিয়ে নানান ঝামেলা ঝক্কির পরে ব্রিটিশ কুঠি এবং দৌত্যের প্রধান ব্যক্তি, জন সুরনাম ফারসি শিখে নেয়। তাদের দৌত্য সফল হয়, কিন্তু কলকাতায় ফিরেই সুরনাম মারা যান এবং ফারসির জ্ঞান তার সঙ্গে কবরে চলে যায়।
১৭৪০ এবং ৫০এর দশকে ক্রমান্বয়ে কোম্পানির অধিকাংশ আমলা কোন না কোন ভারতীয় ভাষা শিখে নেয় এবং উপকূল ছাড়িয়ে তারা ভারতের অভ্যন্তরেও কোম্পানির সেবা করতে থাকে এবং এই ভাষা শেখার জন্যে আরও বেশি দিন তাদের ভারতে থাকার মেয়াদ বাড়ে। সুরাটে ১৯ বছর ধরে কাজ করা জেমস ফ্রেজার ফারসি শিখে পারসিক সূত্রে প্রাপ্ত পারসিক এবং মুঘলদের চিঠি বিনিময়ের সূত্র ধরে নাদির শাহের দরবারের ইতিহাস লেখেন। তিনি একজন পারসিকের থেকে ফারসি শেখেন এবং ক্যাম্বের মুসলমান আইন সম্বন্ধে জ্ঞানীর থেকে তিনি পাঠও নেন।
সেই শতের মাঝখান থেকে অধিকাংশ ব্রিটিশ আধিকারিক তাদের লব্জে মুর বা ইন্দোস্তানি ভাষা আর ফারসি এবং অন্যান্য ভারতীয় অসভ্য(ভালগার) ভাষা শিখতে থাকে। ওয়ারেন হেস্টিংস কাশিমবাজারে ব্যবসায়িক এবং দৌত্যাদি করার সময় ফারসি আর মুর ভাষা শেখে। ব্ল্যাকহোল (কু)খ্যাত হলওয়েল যথেষ্ট বাংলা অর্থাৎ ইন্দোস্তানি জানত যার বলে সিরাজের কলকাতা আক্রমনের বছরে জমিদারি আদালতে বিচারকের চাকরি করত এবং হিন্দুস্তানি শাস্ত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে। উইলিয়াম ওয়াটস, হেনরি ভ্যান্সিস্টার্ট বা লুক স্ক্রাফটনের মত ইওরোপিয়রা এত ভাল দেশিয় ভাষা জানত যে তারা পলাশীর চক্রান্তে সামিল হয়ে উমিচাঁদের মত রাজনৈতিক দালালকে ঘোল খাইয়ে দিতে পেরেছিল। তবে পলাশীর মূল নায়ক ক্লাইভ কিন্তু পর্তুগিজ বাণিজ্য ভাষা ছাড়া বোধহয় অন্য কোন ভাষা জানতেন না। ফলে সে শাসকদের সঙ্গে দরকষাকষি আর অনুবাদকর্মে মূলত তার বানিয়ান নবকৃষ্ণের ওপরে পুরোটাই নির্ভর করত। পলাশী জয় এবং তারপরে রাজস্ব লুঠের কাজে জুড়ে থাকার ফলে প্রচুর আমলা নানান ধরণের ভারতীয় ভাষা শিখতে শুরু করে।

No comments: