তৃতীয় খণ্ড
কাশিমবাজারে বিশাল বিশাল হর্ম্যের কল্যানে তার
পথগুলিতে দিনের উজ্জ্বল আলোতেও কোন দিন সুর্যের রশ্মি ছুঁত না, ফলে বড়
ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে কাশিমবাজারের পরিকাঠামো তৈরি হয়েই ছিল। একদিকে এটি বাংলার
রেশম উতপাদন অঞ্চলগুলির কেন্দ্রে ছিল, অন্য দিকে অষ্টাদশ শতকে এটি ভাগীরথী, পদ্মা
আর জলঙ্গীর তৈরি দ্বীপগুলির ত্রিভূজের মধ্যিখানে অবস্থান করছিল। বাংলার খ্যাতি ছিল
তার নদীপথের জন্য, বোধহয় বিশ্বে এ বাবদে তার তুলনা কেউই ছিল না, এবং বাংলার
নদীপথগুলির মধ্যিখানে ছিল আমাদের আলোচ্য কাশিমবাজার। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়টা ছিল, অষ্টাদশ শতের বাংলার রাজধানীর ক্রোশ দূরেই নবাবের টাঁকশালের খুব কাছেই
অবস্থান ছিল কাশিমবাজার রেশম শিল্প কেন্দ্রের। ফলে রাজধানী আর রাজসভার দালালদের নৈকট্যের সুবিধে পেয়েছিল
কাশিমবাজারের রেশম ব্যবসা।
সপ্তদশ শতের পূর্বের কোন ঐতিহাসিক তথ্যে
কাশিমবাজারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কয়েকটি পরস্পর সংযোগী কাকতালীয় ঘটনার ফলাফলের প্রেক্ষিতেই
বিশ্ববাজারে ব্যবসায়িক কাশিমবাজারের উত্থান। ষোড়শ শতে পূর্ব ভারতের প্রধান বন্দর
সাতগাঁয় পলি পরে মজে যাওয়া, সপ্তদশ শতে হুগলি বন্দরের মৃত্যু এবং অষ্টাদশ শতে
কলকাতা তখনও কোম্পানির হাতে কলকাতা বন্দর না হয়ে ওঠার মাঝামাঝি ধূসর সময়েই
কাশিমবাজার তার বাণিজ্য স্বাক্ষর পেশ করে। সেই সময়ে বাংলার ব্যবসাবাণিজ্যের অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছে কাশিমবাজার। মুর্শিদাবাদ যখন বাংলার রাজধানী হয়ে
উঠেছে, তার ব্যবসায়িক বন্দর হিসেবে বিপুল ব্যবসা দেওয়ার কাজ করে গিয়েছে
কাশিমবাজার।
সপ্তদশীবং অষ্টদশ শতে কাশিমবাজারে বিপুল
ব্যবসাবাণিজ্যের উত্থান ঘটেছে। ভারতের এনং বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন
ভিন্ন প্রকারের ব্যবসায়ির সঙ্গম হত কাশিমবাজারে – কাশ্মীরি, থেকে গুজরাটি থেকে
পারসি থেকে তুর্কি ব্যবসায়িদের ভিড় লেগেই থাকত এই শহরে। নদীর ধারের অসম্ভব
কারুকার্যময় হর্ম্যগুলি এই বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর অন্যতম সাক্ষ্য ছিল।
কাশিমবাজারের এবং তার পরিবেশ সারা বছর ধরে
বিপুল পরিমান রেশম উতপাদন করতে পারত। কাশিমবাজারের রেশম বস্ত্রের উতপাদন ক্ষমতা
নিয়ে তাভার্নিয়ের মন্তব্য যদিও কিছুটা অতিরঞ্জিত, এবং আমাদের সক্কলের জানা, তাই আর
এখানে সেটি নিয়ে বাক্যব্যয় করছি না(ডারমিগনি বলছেন তাভার্নিয়ে বাংলায় এসে দেখেন
কাশিমবাজার ২২ হাজার বেল রেশম বস্ত্র উতপাদন করছে। প্রত্যেক বেলের ওজন ১০০
পাউন্ডের কাছাকাছি। মোট উতপাদন হয়ত ৩১ লক্ষ পাউণ্ড যার মধ্যে ৩ থেকে চার লক্ষ
পাউণ্ড ক্রয় করে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি। ইওরোপিয় ইন্সট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলির মধ্যে
ডাচেরাই সব থেকে বেশি রেশম ক্রয় করত এবং মোট উতপাদনের একতৃতীয়াংশ ৬০০০ থেকে ৭০০০
বেল কিনে নিত ভিওসি। তাদের ইচ্ছে থাকত আরও আরও বেশি কেনার কিন্তু ভারতীয় এবং
অন্যান্য এশিয় ব্যাপারীদের সঙ্গে তারা খুব বেশি পেরে উঠত না। মনে রাখতে হবে
ব্রিটিশেরা কোরা রেশমকে ওজন করেছে ১৬ আওন্সের বদলে ২৪ আউন্সে)। কোরা রেশমকে কয়েকটি
মরশুমি উতপাদনে ভাগ করা যেত নভেম্বরের উতপাদন(সবথেকে ভাল), মার্চেরটি, তার পর জুন
জুলাইএর(সব থেকে খারাপ)। এছাড়াও গুজরাট নামে এক প্রকার বস্ত্র উতপাদন করত,
ব্যবসায়িকভাবে গুজরাটে যেত, আর ছিল কুমারকুলি রেশম, তৈরি হত কুমারখালিতে আর সব
থেকে দামিটির নাম ছিল পাঞ্জিপুর রেশম, এই শেষতম উতপাদনটি মাঝেমধ্যেই ইওরোপিয়রা
কিনত(কেউ কেউ একে গুজরাটও বলেছেন, কিন্তু এই দুটি বৈচিত্রকে কোম্পানিগুলির বার্ষিক
ইনভেস্টমেন্ট তালিকায় আলাদা শীর্ষক করে দেখানো হয়েছে)। এছাড়াও ছিল রেশমসুতি
মিলেমিশে কটন সিল্ক গুডস, এবং বেশ মোটা কোরা আর দোসুতি। বিনিয়োগ হত কোরা রেশম
শীর্ষকে, সিল্ক পিস গুডস, কোরা আর দোসুতি, শেষ দুটিকে একসঙ্গেই ধরা হত। এই সবগুলিই
চাহিদাবন্ত রেশম পণ্য ছিল, বিশেষ করে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির কাছে। এতা পরিষ্কার
কাশিমবাজারের যে সব থেকে দামি রেশমটি ব্রিটিশ কোম্পানির বিক্রিতে দাম পেত না, বরং
সেটি যে শেষ দুটি বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করা গিয়েছে একটু আগে তার ৩০% থেকেও কম
দামে বিক্রি হয়েছে লন্ডনের বাজারে। ব্রিটিশদের চাহিদা অনুযায়ী যে ধরণের প্রক্রিয়া
করা হত সব থেকে ভাল রেশম বস্ত্রটি, তার জটিলতা আর দীর্ঘসূত্রিতার জন্যই পণ্যটি অন্যান্য
পণ্য বৈচিত্র্যে দামের প্রতিযোগিতার সঙ্গে পেরে উঠত না। ফলে বাজারে খুব সহজে
বিক্রি হত মাঝারি ধরণের দামের কোরা রেশম। এই তথ্যটা আমরা হয়ত সবাই জানি যে
পূর্ব-দেশিয় বাজারে চিনের পরে যে ভৌগোলিক অঞ্চলটি সব থেকে বেশি বৈচিত্রের এবং
দামের রেশম উতপাদন করত তার নাম কাশিমবাজার।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment