আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান
দ্বিতীয় খণ্ড
১১। তাঁর উত্তরাধিকারীর প্রতি উপদেশ। বিষণ্ণ ভবিষ্যদ্বানী
শাহজাদা মুহম্মদ মুয়াজ্জম বাহাদুর শাহকে সম্রাট মুক্তি দিয়ে আনুকূল্য প্রদর্শন করলেন এবং নানান উপহার দিলেন। যেদিন শাহজাদা উপহারগুলি নিয়ে চলে যাবেন, সেদিন সম্রাট তাকে ডেকে বললেন, ‘ভীষণ জরুরি মনে করে আমি তোমার প্রতি যে ব্যবহারটা দেখিয়েছি, তার জন্য অন্য কোন উপায় ছিল না আমার, আমি তোমার ব্যবহারে কতগুলি ধ্বংসকর চরিত্র দেখে তোমায় বেশ কিছু বছর কারাগারে রাখতে বাধ্য হয়েছি, কেননা (আমি মনে করছি) এইভাবে তোমার গোষ্ঠীত্ব(নেতৃত্ব) বাড়বে, কেননা, য়ুসুফের ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা এবং রাজত্ব পাওয়া নির্ভর করছিল তাঁর (প্রথম)কারাগারের বছরগুলির ওপর। ওপরওয়ালার দয়া যদি হয়, তাহলে সেই ঘটনটা তোমার জীবনেও পুনরায় ঘটবে। এই আশায় আমি আমার জীবদ্দশায় এই গুলিস্তাঁ হিন্দোস্তানের দেওয়ান রূপে বিশ্বাস করে গড়ে তুলেছি-
আমার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভাগ্যগণনার যে পূর্বলক্ষণ ফাজিল খাঁ আলা উল মুলক গণেছেন, সেটি আমি মিলিয়ে দেখেছি(ঠিকুজির সঙ্গে জীবনের কিছু ঘটনা মিলিয়ে দেখার কিছু অংশ বলা হয়েছে মাসিরউলউমারায়)। সেই ঠিকুজিতে বলা হয়েছে(যার অনুবাদ ঠিক এরকম, ‘এই সম্রাটের পরে শমকইরামিক এবং শমকইযাজল(সিংহরাশির নক্ষত্রপুঞ্জের দুটি অংশ) জীবন ভাগ করবে এবং তার পরে সাম্রাজ্যের পতন শুরু হবে’, আমার পরে যে সম্রাট সিংহাসনে আরোহন করবে, সে হবে অনুদার, সঙ্কীর্ণচেতা, অজ্ঞ এবং রোগেভোগে জর্জরিত – যার বাক্য হবে অসম্পূর্ণ এবং যার পরিকল্পনাগুলি হবে অপরিণত। কিছু মানুষের সাহায্যে সে এতই অমিতব্যয়ী এবং অন্যান্যদের সঙ্গে এতই লড়ালড়ি করবে যে, তাতে তার ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবলভাবে রয়েছে। এই সব মননশীল এবং প্রশংসাসূচক উক্তি তিনি তোমার চরিত্রে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। আমার সাম্রাজ্যে আমার সঙ্গে কাজ করেছিল এক দক্ষ উজির, আমি তাকে কাজ করতে দিয়েছিলাম, কেননা আমি জানতাম সে কি করতে পারে। কিন্তু আমার জীবনের চারটে স্তম্ভ, আমার চার সন্তান, তাকে তার কাজ করতেই দেয় নি। এতদ সত্ত্বেও সে কিন্তু তার মত করে সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের কাজ যাতে ভালভাবে চলে তা দেখে গিয়েছে। এটা ওষুধ শাস্ত্রের নীতি, যদিও দেহকাণ্ডের নিম্নঅংশ তার শক্তি বজায় রাখে, ওপরের অংশের রোগাঘাত সহ্য করেও, ওপর অংশের মত অতটা খারাপ না হয়ে পড়েও, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখা যায় সেই রোগ কিন্তু দেহকাণ্ডে শক্তিহীনতা এবং মন্থরতা সৃষ্টি করে এমন কি (দেহকাণ্ডে) বিশৃঙ্খলতা এবং মৃত্যু ডেকে আনে। এই কাণ্ডটাই, তোমার ক্ষেত্রে ঘটবে। আমি সারাজীবন মাঠে ঘাটে জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি, আমার সেই কাজে কিছু আমার আধিকারিক, যারা তাদের জীবনে শান্তি পছন্দ করে, তাদের পিতামাতার প্রতি অভিম্পাত প্রদান করেছে, এবং যাতে আমার এই নশ্বর জীবন তাড়াতাড়ি ক্ষয় হয়ে যায়, তার জন্যও দোয়া করেছে – এবং আমার মৃত্যুর পরে, তারা আমার এই চিন্তাহীন, জ্ঞানহীন সন্তান, যে কোন রকম মেধা, গুণপনা সহ্য করতে পারে না, তারা সর্বশক্তমানের কাছে, আমার মৃত্যুর যেমন দোয়া করেছে, তোমার জন্যও তাই করবে। যাই হোক, আমি তোমায় পিতৃসুলভ ভালবাসায় পরামর্শ দিচ্ছি, ‘এমন ভাবে (তোমার বাক্য)লবণাক্ত কোর না, যাতে সকলে তোমার দিকে থুথু ছেটায়, আর এমন মিষ্টভাষী হয়োনা, যার ফলে তারা তোমায় গিলে ফেলতে পারে’। কিন্তু এই পরামর্শ এখানে দেওয়ার উপযুক্ত স্থান নয়, কেননা তোমার চরিত্র লবনাক্ত নয়, কিন্তু তা তোমার প্রিয় ভাইদের চরিত্রে রয়েছে। আমার বিচক্ষণ পুত্র, তোমার চরিত্রে বেশিরভাগটাই লবনতাবিহীন। আশাকরি সর্বশক্তিমান ভাইদের মিলিয়ে-জুলিয়ে রাখবেন। আমেন, সর্বশক্তিমান।
মন্তব্য - আওরঙ্গজেবের প্রিয়তম উজির হলেন আসাদ খাঁ। ফাজিল খাঁ, বহুধাজ্ঞানের জ্ঞানী, শাহজাহানের খানইসামান ছিলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment