কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা
রীলা মুখার্জী
৩) আর দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয় দেশগুলির বাণিজ্য বিষয়ে কথা বলতে গেলে বলা যায়, বাংলা এমন সময়ে মোগল সুবার অন্তর্গত হয়ে গেল, যখন এই সব দেশগুলির একের পর এক সমুদ্র বন্দর তাদের সামনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
১৫১১য় মালাক্কা পর্তুগিজেরা দখল করায় বাংলা থেকে টম পিরেস আচে এবং পাসেতে ব্যবসা করার জন্য বাংলার ব্যবসায়ী মনোনীত করতে থাকলেন। মালাবার, ক্যাম্বে, পোগু, টেনাসরিন, আচে, সিংহল, এমন কি মালাক্কাতে যে সব বাংলার ব্যবসায়ী ব্যবসা করতেন তাদের বলা হর বার্বোসা। পর্তুগিজেরা তাদের আগের নীতি মুসলমান ব্যবসায়ীদের আক্রমন করার যে নীতি নিয়েছিল, সেটা বাতিল করায় ১৫৯৯ সালে আচেতে বাঙ্গালি ব্যবসায়ীদের বসতি গড়ে উঠল।
১৬৪০এ পর্তুগিজেরা আরাকান দখল করায় বাংলার ব্যবসায়ের পালে আর বেশি হাওয়া বইতে শুরু করল। কিন্তু বাংলায় পর্তুগিজেদের ছেড়ে যাওয়া ব্যবসা দখলের ডাচেদের চেষ্টা আঘাত পেতে থাকে বিশাল সংখ্যায় মুসলমান ব্যবসায়ী এবং জাহাজ মালিকদের ব্যবসার ব্যপ্তিতে।
এই সময়ে পিয়েত্রো দেলা ভালা বলছেন বাঙালি ব্যবসায়ীরা মালদ্বীপে ব্যবসা করছে। মধ্য সপ্তদশ শতে বাঙালি ব্যবসায়ীরা বর্মা এবং থাই বাজারে ঢুকছেন মার্গনি এবং টেনাসেরিন হয়ে, এবং সেই শতের শেষের দিকে টামাস বাউরি বলছেন হুগলিতে বিশাল সংখ্যক নৌবাণিজ্য এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কথা।
চিন্তানন, খেমচাঁদ বা মথুরদাসের মত বাঙালি ব্যবসায়ীদের কথা বলেছেন সুশীল চৌধুরী, কিন্তু ১৬৮০ নাগাদ বাংলার নৌবাণিজ্যের পতন শুরু হয়ে গিয়েছে। সুবাদারেরা নিজেদেরকে নৌব্যবসার অংশিদারি থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন, বাংলার নবাব নৌউদ্যমে বিন্দুমাত্র উতসাহ দেখাচ্ছেন না। ফলে বাঙালি ব্যবসায়ীরা রাজসিক নৌবহরগুলি হারালেন, উপরন্তু সুরাটি ব্যবসায় একটাও বহর বানাতে পারলেন না। ফলে সপ্তদশ শতকে তার একটাই উদ্দেশ্য বিভিন্ন কোম্পানির জাহাজে মাল পাঠাবার উদ্যম নেওয়া। বিশাল সুবাদারি জাহাজগুলি ব্যবসা থেকে নিজেদের তুলে নেওয়ায় কলকাতার জাহাজগুলি সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এল।
নৌবাণিজ্যের পতন যে শুধু বাংলায় হয়েছে, এমন মন্তব্য করা ঠিক হবে না, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে নৌবাণিজ্যের পতনের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। ১৫১১র পর্তুগিজদের মালাক্কা দখল মালয় বাণিজ্যে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করল, এশিয়ার সামগ্রিক আন্তর্জাতিক নৌবন্দরের একতা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পাসে, আচে, জোহর, ব্যান্টাম, ব্রুনেই এবং মাকাসসারের মত ছোট ছোট বন্দরগুলি নিজের মত করে পূর্বের সামগ্রিক মালাক্কা ব্যবসার রীতি টানার চেষ্টা করতে লাগল। ষোড়শ শতে যখন পর্তুগিজেরা নতুন করে মুসলমান মালাক্কায় আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, বহু নতুন বাণিজ্য পথ খুলে গিয়েছেঃ একমাত্র মার্গুই, টেনাসেরিম, পাটানি, ব্যান্টাম এবং আচে এই উথালপাথালে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল।
এইকটি বন্দর কিন্তু সপ্তদশ শতে মালাক্কা ব্যবসায় যে স্থান হারিয়েছিল, সেই স্থান পূরণের চেষ্টা করতে লাগল। ইস্কান্দার মুদার নেতৃত্ব আচে গড়ে উঠল বিপুল ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে। ১৬৩৬এ মৃত্যুর পর ডাচেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আচের রাণী চেষ্টা করে গিয়েছেন আচে বন্দরকে মুক্ত বন্দর হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখার। ১৬৩২ সালে বাংলা থেকে পর্তুগিজেদের বার করে দেওয়ার পরে বাংলার বহির্বাণিজ্যে যে উতসাহ দেখা দিল, ১৮৩৬সালে আচের পতনের পরে সেই বাণিজ্য বৃদ্ধি সম্ভাবনা বাধাপ্রাপ্ত হল।
সপ্তদশ শতে ডাচেদের এই অঞ্চল - ১৬৪১এ মালাক্কা, ১৬৬৩তে মলুকাস, ১৬৬৭তে টিডোর, ১৬৬৯তে গৌয়া এবং ১৬৮২-৮৪তে ব্যান্টাম দখল করায় এই অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার নৌ বাণিজ্য সম্পর্ক প্রায় চ্ছিন্ন হতে বসে। এই সময়ে জোহর, খেদা এবং পেরাকের মত ছোট ছোট বন্দরের উত্থান ঘটে, এবং মালাক্কা, আচে এবং বান্টামের মত বড় বন্দর হাতের বাইরে গেলেও পূর্বেরগুলি সান্ত্বনা পুরস্কারের মত থেকেই যায়।
ফলে সপ্তদশ শতের দ্বিতীয় পর্বে বাংলার সঙ্গে নৌবাণিজ্য কর্ম ইন্দোনেশিয়া এবং মালয় অঞ্চল বাদ দিয়ে সংহত হয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বার্মা এবং থাইল্যান্ড অঞ্চলে। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে বাংলার নৌবণিকেরা আচে, কেডা, জোহর, আরাকান, পেগু, টেনাসেরিম এবং আয়ুথিয়ার সঙ্গে করমণ্ডল, মালাবার, মালদ্বীপ এবং সিংহলেও ব্যবসা করত।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment