কাশিমবাজারের ইতিহাসঃ রেশম ব্যবসায়ী এবং অষ্টাদশ শতের ব্যবসা
রীলা মুখার্জী
এমনকি সমুদ্রে এবং স্থলপথের বহু বাজারও ক্রমশ ব্যবসায়ীদের হাতের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতের প্রথম দিকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পূর্ব উপকূলের করমণ্ডলগামী বাংলার ব্যবসায়ীদের টক্কর দিতে শুরু করে। পশ্চিম উপকূল কিছুটা হলেও উন্মুক্ত এলাকা ছিল, কলকাতার নৌবহর মাদ্রাজ, ডাচ, পর্তুগিজ এবং বাংলার বাণিজ্যিক নৌবহরগুলির সঙ্গে ব্যবসায়িক পাল্লা দিত। মালদ্বীপের দিকের বাণিজ্যপথেই একমাত্র ইওরোপিয়রা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত না।
১৭৪০ নাগাদ সিয়াম এবং মালয়ের খুব পুরোনো বাজার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে, এবং পরের শতের দিকে ব্যবসার জোরটা পশ্চিমের থেকে পূর্বের দিকে সরে আসছে নতুন বাজারের দিকে, নতুন পণ্য সম্ভার সম্বল করে, নতুন ব্যবসায়িক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সম্পর্কে একটাই কথা বলা যায় বার বার তারা একের পর এক সুযোগের অপচয় ঘটিয়েছে। শত শত বছরের অস্থির রাজনৈতিক অব্যবস্থা এবং ভিন্ন ধর্মের শত্রু রাজশক্তি তাঁকে শিখিয়েছিল খুব বেশি ঝুঁকি না নেওয়ার কথা। সুলতানি আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাণিজ্যিক নানান সুযোগ সুবিধে এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে নির্বাসিত মুসলমান ব্যবসায়ীরা। তাদের পরে নানান বাণিজ্যকর্মের যায়গাটি দখল করেছে বড় পুঁজির পর্তুগিজ, গুজরাটি, ডাচ এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ী। অবাঙ্গালি ব্যবসায়ীদের তুলনায় বাঙালি ব্যবসায়িদের একটা বড় সুবিধে ছিল, পশ্চিম এবং উত্তরভারতের তুলনায় বাংলা ছিল বিপুল বড় গ্রামীন এলাকা, বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক কারণের জন্য শহর ছিল ক্ষণস্থায়ী চরিত্রের ভূখণ্ড, এবং পরম্পরার উতপাদকেরা শহরে প্রায় বসবাসই করত না। উতপাদন এবং বস্ত্রশিল্পীরা বাংলার গ্রামীন ভূখণ্ডজুড়ে ছড়িয়েছিল এবং এই ব্যবসায়ীরা তাদের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে সেই সব উতপাদকেদের তৈরি পণ্য নিয়ে আসার কাজ করত। যেহেতু সারা বিশ্ব বাংলার ব্যবসায়ীদের সংগৃহীত পণ্যের জন্য উন্মুখ ছিল, তাই তাকে কষ্ট করে আর বাণিজ্যের জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে হয় নি, সে গদিতে বসে বসেই ব্যবসা করতে পারত। গড় ব্যবসায়ী বৈদেশিক বাণিজ্য, পণ্য আনা-নেওয়া এবং দূরদেশের বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজ অন্যদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজের দেশের পণ্য সংগ্রহের কাজটি নদীমাতৃক দেশের মানুষ হয়ে নদীতে বহন করে সংগৃহীত করতে পারত। বাংলার বণিক করমণ্ডল উপকূলের বণিকদের মত মূলত ছিলেন সংগ্রাহক, সরবরাহকারী – যাদের ব্রিটিশ বণিকেরা কলতেন ‘দাদনি’ বণিক।
(প্রথম খণ্ড শেষ)
No comments:
Post a Comment