দ্বিতীয় খণ্ড
ইওরোপিয়দের কাছে রেশম ছিল নতুনতর পণ্য। এই নতুন পণ্যের ব্যবসার প্রথম দিকে ডাচেরা ছিল একমাত্র বিদেশি। এবং রেশম ব্যবসাই ডাচ কোম্পানির লাভের ভাগ্য ফেরানোর অন্যতম কারিগর। ১৬২০ সালে তারা বাংলার উপকূলে একটি বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে একটি বাণিজ্য কুঠি তৈরি করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করল। বাংলায় তার রেশমের ব্যবসাই শুরু হল বছরে ১৫০০০-২০০০০ পাউণ্ডের রেশম বস্ত্র দিয়ে। ১৬৩৫-৪০ সালে দাঁড়াল বছরে ৫০০০০ পাউন্ড, ১৬৫০ সালে ২ লক্ষ পাউণ্ড। ১৬৫৪ সালের পর কেনার গড় থিতু হল বছরে ১ লক্ষ পাউন্ডে। সেই শতের সাতের এবং আটের দশকে কিছুটা কমতে শুরু করল ডাচেদের রেশম কেনার ধুম। যখন তারা নতুন করে ফিরে এল, তখন কিন্তু তারা এই পণ্যটি ব্রিটিশদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে কিনেছে। এই সময়ে ডাচেরা বাংলার রেশম জাপান থেকে হলন্ডে রপ্তানি করেছে। ১৬৯৩-৯৪ সালে ডাচেদের ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যগুলির মধ্যে বাংলা থেকে কেনা পণ্যই সব থেকে বেশি ছিল ৫৭.৮শতাংশ(যার মধ্যে বাংলা সুবার পাটনার সরকার সারণের সোরাও একটা বড় পণ্য ছিল - অনুবাদক) এবং জাপানে পাঠানো পণ্যের মধ্যে বাংলার পণ্যের অংশিদারি ছিল ৩৭.৩ শতাংশ।
ব্রিটিশ কোম্পানিও ডাচেদের খুব বেশি পিছনে ছিল না। ১৬২০ সাল নাগাদ সুরাট পণ্যের ওপরে নিজেদের নির্ভরতা কমাতে হুঘি আর পার্কারের নেতৃত্বে বাংলায় একটা বাণিজ্য মিশন পাঠায় তারা। তাদের কাজ ছিল বাংলা-বিহারের পণ্যগুলির মূল্যমান নির্ধারণ করা।
এই মিশনটি খুব সফল হয় নি, কেন না তাদের অধিকাংশ সুপারিশই সুরাটের উচ্চ আধিকারিকেরা বাতিল করে দিয়েছিলেন। অথচ ব্যবসায়িকভাবে কিন্তু হুঘি আর পার্কার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্য আবিষ্কার করে গিয়েছিলেন – সেগুলির মধ্যে অবশ্যই রেশম ছিল। তাদের সুপারিশ ছিল বাংলার মুর্শিদাবাদের পরিবেশে খুব ভাল রেশম তৈরি হয় এবং সর্বভারতীয় দামের তুলনায় এখানে কম করে ২০% কম দামে রেশম বস্ত্র কেনা যায়। তাদের এই সুপারিশে পরের ৩০ বছর ধরে ধুলো জমবে, যতক্ষণনা ১৬৫৮ সালে ডাচেদের পিছন পিছন ব্রিটিশেরা কাশিমবাজারে তাদের গুদাম খুলছে।(১৬৬৪-১৬৮৫ পর্যন্ত এই নব্য পণ্যে ব্রিটিশ বিনিয়োগের নানান ওঠানামা হয়েছে। ১৬৮০তে কোর্ট অব দ্য কমিটি তাদের কর্মচারীদের নির্দেশ দেয় বাংলায় রেশম ব্যবসায় বিনিয়গের পরিমান বাড়াতে। তারা জানায় কোম্পানির সবথেকে বড় দুটি-তিনিটি রপ্তানি জাহাজ ভর্তি করে যদি রেশম ইওরোপে পাঠানো যায় তাহলে কোম্পানির লাভের ওপর কোন চাপ পড়বে না)।
১৬৮১ সালে বাংলায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার স্টার্লিং বাংলায় বিনিয়োগ(পণ্য কেনার পরিমানটাকে ইওরোপিয়রা বিনিয়োগ বলতেন) করে ব্রিটিশরা, যার মধ্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার পাউণ্ড বিনিয়োগ ছিল শুধু কাশিমবাজারের ব্যবসায়। ১৬৯৮তে ইতালি এবং ফ্রান্সের রেশম উতপাদন ব্যহত হওয়ায় লন্ডনে বাংলার রেশম সর্বোচ্চ দামে বিকোল। ১৭০০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত মোটামুটি বার্ষিক একই গড় হারে বাংলার রেশমই ইওরোপে আমদানি করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেশমের উতপাদন সত্ত্বেও ১৭৩০ সাল নাগাদ কাশিমবাজার থেকে সব থেকে বেশি পরিমান রেশম বস্ত্র কিনতে শুরু করে ব্রিটিশরা। ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের০ দাদনি বণিকদের মোট অগ্রিম দেওয়ার পরিমান ছিল ১৯১৭৫০ পাউণ্ড, অন্যদিকে ঢাকার ব্যবসায়ীদেরকে অগ্রিম দেয় ১২২৫২৬ পাউন্ড। একশ বছর আগে লিযঁ ইওরোপের সব থেকে বড় রেশমের বাজার ছিল, ডাচেদের বাংলা রেশম ক্রয়ের বিপুল উদ্যমে সেই ব্যবসার কেন্দ্রস্থল লিয়ঁ থেকে সরে গিয়েছিল আমস্টার্ডামে; কিন্তু বাংলায় আস্তে আস্তে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাচে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনায় অনেক বেশি সাফল্য পেতে শুরু করায় ক্রমশ ডাচেদের রেশম ব্যবসায় ইওরোপিয় আধিপত্য মার খেতে শুরু করে, শেষমেশ ১৭৩০-৪০এর দশকে আমস্টার্ডাম থেকে ইওরোপের রেশম ব্যবসার কেন্দ্রস্থল সরে এল লন্ডনে।
ফরাসি কোম্পানিও বাংলার রেশম ব্যবসায় পিছনে পড়ে থাকল না। ১৬৬০ সালে বার্নিয়ে ফরাসি কোম্পানিকে বাংলার রেশম ব্যবসায় আর বেশি মন দিতে বলছেন, তার মতে বাংলার রেশম লন্ডনে বিক্রি হওয়া ইওরোপিয় রেশমের তুলনায় বেশ উত্তম, কিন্তু সিরিয়ার রেশম থেকে একটু কমা। ১৬৮০ সাল নাগাদ সব কটি কোম্পানিই কাশিমবাজারের তাদের ব্যবসায়িক দপ্তর খোলে – খোদ কাশিমবাজারে যায়গা নেয় ব্রিটিশেরা, কালকাপুরে ঘাঁটি স্থাপন করে ডাচেরা আর আর্মেনিয়দের দেখাদেখি ফরাসিরা সৈদাবাদে বিশাল একটা বাগান সহ ভিলা স্থাপন করে।
{দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত}
(চলবে)
No comments:
Post a Comment