তৃতীয় খণ্ড
৪৮। দুশ্চরিত্রের অভিজাতকে বন্দী করলেন
প্রধানমন্ত্রীর কন্যার পুত্র মির্জা তাফাখুর, দিল্লির মানুষের সঙ্গে দুর্বৃত্তের মত ব্যবহার করত, মানুষের সম্পত্তি এবং সম্মানে আঘাত করত, খোলা বাজারে তার অনুগামীদের সঙ্গে এসে তরিতরকারি, খাবার দোকান লুঠ করত, এবং নদীতে নাইতে আসা হিন্দু মহিলাদের নানারকমভাবে উত্যক্ত, অসম্মান করত। যতবার বিষয়টি সংবাদ বাহকেরা সম্রাটের নজরে এনেছে, ততবারই তিনি তার ওপরে শুধু ‘প্রধানমন্ত্রী’ লিখে ছেড়ে দিয়েছেন।
নানান অভিযোগ শুনতে শুনতে, শেষে যখন সম্রাট জানলেন, একজন বাকসারিয়া ঘনশ্যাম, নতুন বিয়ে করে, নিজে ঘোড়ায় চড়ে, তার স্ত্রীকে একটা ডলিতে বসিয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গে মির্জা তাফাখুরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, মির্জার সাঙ্গপাঙ্গরা তাদের ওপর চড়াও হয়, ডোলি থেকে নববধুকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। এই তুমুল লড়াইয়ের ঘটনায় দুজন মারা যায় এবং ছজন আহত হয়। তার বন্ধু সেনা তোপদারেরা এই খবর পেয়ে(তাদের সঙ্গীর ওপর অত্যাচারের) মির্জার দরজায় জড়ো হয়। আকিল খাঁ কোতোয়ালকে পাঠালেন তাদের আটকাতে। তার পর তিনি একজন খোজাকে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা আর মির্জার মা, কামারউন্নিসার কাছে পাঠিয়ে প্রকাশ্যে তিরষ্কার করেন এবং আঘাত করেন। জাত এবং সম্মান খোয়ানো হিন্দু মহিলাটিকে খোজার হাতে দেওয়া হয়, এবং তিনি জড়ো হওয়া তোপদারদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে, এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন খবরের কাগজে লেখা হবে, সম্রাট নিশ্চই এই ঘটনার(অভিযোগের) প্রতিবিধান করবেন। তারা আর কোন পদক্ষেপ না নিয়ে চলে যায়।
সম্রাট এই সংবাদ পাঠ করে, সেই সমীক্ষার ওপরে লিখলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ‘সম্রাটের নির্দেশে চিঠি’ লিখুক আকিল খাঁকে, যে সে যন এই দুর্ভাগ্যতাড়িত, অপদার্থ, দুর্বৃত্তকে দিল্লির দুর্গে বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেয়; আর যদি তার মা, তার পুত্রের প্রতি চিরাচরিত বাতসল্যে তাকে যেতে দিতে অস্বীকার করে, তাহলে একটা চৌদল পাঠিয়ে, কামারুন্নিসা বেগমকে সম্মান দেখিয়ে তার পুত্রের সঙ্গে বন্দী করে রাখুক। আকিল খাঁ কামারুন্নিসা বেগমের থাকার জন্য একটা ভাল প্রসাদ দেখুন। সে যেহেতু আমার মামার কন্যা, এবং নানান অভিজাতিক গুণে গুনান্বিত, আমি তার প্রতি বাইরে এবং অন্দরেও সহানুভূতিশীল। কিন্তু নবী নোয়াও তার অপদার্থ পুত্রকেও যখন সামলাতে পারেন নি, তখন মরণশীল পিতামাতারা কি করে তাদের সন্তানদের সংস্কার করতে পারে? আমার দায় হল জনগণের ওপর নানান অত্যাচারের প্রতিবিধান করা, তারা সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা। কোতোয়ালের পঞ্চাশজন প্রতিরক্ষী তাফাখুরের বাড়ি পাহারা দিক যাতে এই আস্তিনের সাপটি তার গর্ত থেকে না পালাতে পারে। (কবিতা)
এই ধরণের শয়তানিতে ভরপুর অপদার্থ সন্তানেরা / প্রখ্যাত অভিজাত পরিবারের পিতামাতার সম্মান ধুলোয় মিলিয়ে দেয়।
এক্ষুনি, প্রধানমন্ত্রী ‘নির্দেশক্রমে চিঠি’ লিখবে, সেটির মুখ বন্ধ করার ও সম্রাটের সামনে পেশ করার আগে সম্রাটের বয়ানে একটা চিঠি আকিল খাঁয়ের সামনে পেশ করবে। এই চিঠিটির বিষয়টা হল, ‘আমার প্রিয় অনুগ্রহশীল বন্ধু, সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের দাবিতে আমি বিশ্বাস করি পারি যে তুমি দুর্বৃত্ত তাফাখুরের আত্মীয়(আঙ্কল)। যদি তুমি একজন খোজা পাঠিয়ে তাকে তোমার সামনে ডেকে এনে তাঁকে নগ্ন করে পঞ্চাশ ঘা চাবুক মারতে তাতে তোমার ভাইয়ের হৃদয় হয়ত শান্তি পেত। চাবুকের রাজসিংহাসন, আমার বুকের পোঁতা হৃদয়কে বার করে নিয়েছে(আমার নাতির কাজে)’।
এটি পাঠ করে সম্রাট লিখলেন, ‘আমার মামীর কন্যার পুত্রকে কেউ আঘাত করতে পারে না। আমার জীবন যদি ততদিন থাকে, এবং মৃত্যু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা অনুসারে আমি তাঁকে আমার হাতে পেটাই করব। সে আমার পুত্রসম। কিন্তু সন্তান যদি দুর্বৃত্ত হয় তাহলে (সে রকম)সন্তানের প্রয়োজন কি? দাসকে আঘাত করার অর্থ তার মনিবকে অপমান করা(অন্য একটি পাণ্ডুলিপিতে আছে, ‘লেখার আর মুখে বলার যে মর্যাদা আমরা দিচ্ছি(তাফাখুরের বিষয়ে) তা একটি প্রবাদের অনুসারী, ‘দাস পেটানোর অর্থ, মালিককে অসম্মান করা’। একজন দারুণ সম্পর্ক সংযোগ রক্ষা করা অভিজাত যদি খারাপ কাজ করে, সেই অপমান আমরা রাখব কোথায়?’)।
মন্তব্য – আসাদ খাঁ সাম্রাজ্ঞী মুমতাজ মহলের চার বোনের একজনকে বিবাহ করেন, সেই সম্পর্কে তিনি আওরঙ্গজেবের মামা। আসাদ খাঁয়ের অন্যান্য প্রখ্যাত উত্তরাধিকারীর সম্বন্ধে বিশদে বলা হয়েছে মাসিরউলউমারায়। তাফাখুরের বন্দীত্বের সূত্র পাওয়া যায় আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্রে, এনায়েতুল্লার আহকমইআলমগিরিতে। আর ১৬৮২তে ঢাকায় তাফাখুরের মাতলামোর সূত্র পাওয়া যায় ব্রিটিশ এজেন্ট হেজেসের ভ্রমণকাহিনীতে(হেজেস, ডায়েরি)। বাকসারিয়া বা বক্সারের হিন্দু তোপদাগা সৈন্যদের কথা এখানে বলা হচ্ছে, আজকে এদের বলা হয় ভোজপুরি। এই অঞ্চল বহুদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জমিদারদের বন্দুকবাজ এবং লাঠয়াল সরবরাহ করেছে। আকিল খাঁ, উপাধি রাজি, ১৬৮০ থেকে ১৬৯৬ পর্যন্ত দিল্লির সুবাদার ছিলেন। নোয়ার দায়িত্বহীন পুত্রের নাম ক্যানন। ‘নোয়া তার মদ্যপান থেকে উঠে বুঝলেন তার ছোট ছেলে তার কি হাল করেছে। এবং তিনি বললেন, ক্যাননকে অভিশাপ দাও’।
(চলবে)
৪৮। দুশ্চরিত্রের অভিজাতকে বন্দী করলেন
প্রধানমন্ত্রীর কন্যার পুত্র মির্জা তাফাখুর, দিল্লির মানুষের সঙ্গে দুর্বৃত্তের মত ব্যবহার করত, মানুষের সম্পত্তি এবং সম্মানে আঘাত করত, খোলা বাজারে তার অনুগামীদের সঙ্গে এসে তরিতরকারি, খাবার দোকান লুঠ করত, এবং নদীতে নাইতে আসা হিন্দু মহিলাদের নানারকমভাবে উত্যক্ত, অসম্মান করত। যতবার বিষয়টি সংবাদ বাহকেরা সম্রাটের নজরে এনেছে, ততবারই তিনি তার ওপরে শুধু ‘প্রধানমন্ত্রী’ লিখে ছেড়ে দিয়েছেন।
নানান অভিযোগ শুনতে শুনতে, শেষে যখন সম্রাট জানলেন, একজন বাকসারিয়া ঘনশ্যাম, নতুন বিয়ে করে, নিজে ঘোড়ায় চড়ে, তার স্ত্রীকে একটা ডলিতে বসিয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গে মির্জা তাফাখুরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, মির্জার সাঙ্গপাঙ্গরা তাদের ওপর চড়াও হয়, ডোলি থেকে নববধুকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। এই তুমুল লড়াইয়ের ঘটনায় দুজন মারা যায় এবং ছজন আহত হয়। তার বন্ধু সেনা তোপদারেরা এই খবর পেয়ে(তাদের সঙ্গীর ওপর অত্যাচারের) মির্জার দরজায় জড়ো হয়। আকিল খাঁ কোতোয়ালকে পাঠালেন তাদের আটকাতে। তার পর তিনি একজন খোজাকে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা আর মির্জার মা, কামারউন্নিসার কাছে পাঠিয়ে প্রকাশ্যে তিরষ্কার করেন এবং আঘাত করেন। জাত এবং সম্মান খোয়ানো হিন্দু মহিলাটিকে খোজার হাতে দেওয়া হয়, এবং তিনি জড়ো হওয়া তোপদারদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে, এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন খবরের কাগজে লেখা হবে, সম্রাট নিশ্চই এই ঘটনার(অভিযোগের) প্রতিবিধান করবেন। তারা আর কোন পদক্ষেপ না নিয়ে চলে যায়।
সম্রাট এই সংবাদ পাঠ করে, সেই সমীক্ষার ওপরে লিখলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ‘সম্রাটের নির্দেশে চিঠি’ লিখুক আকিল খাঁকে, যে সে যন এই দুর্ভাগ্যতাড়িত, অপদার্থ, দুর্বৃত্তকে দিল্লির দুর্গে বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেয়; আর যদি তার মা, তার পুত্রের প্রতি চিরাচরিত বাতসল্যে তাকে যেতে দিতে অস্বীকার করে, তাহলে একটা চৌদল পাঠিয়ে, কামারুন্নিসা বেগমকে সম্মান দেখিয়ে তার পুত্রের সঙ্গে বন্দী করে রাখুক। আকিল খাঁ কামারুন্নিসা বেগমের থাকার জন্য একটা ভাল প্রসাদ দেখুন। সে যেহেতু আমার মামার কন্যা, এবং নানান অভিজাতিক গুণে গুনান্বিত, আমি তার প্রতি বাইরে এবং অন্দরেও সহানুভূতিশীল। কিন্তু নবী নোয়াও তার অপদার্থ পুত্রকেও যখন সামলাতে পারেন নি, তখন মরণশীল পিতামাতারা কি করে তাদের সন্তানদের সংস্কার করতে পারে? আমার দায় হল জনগণের ওপর নানান অত্যাচারের প্রতিবিধান করা, তারা সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা। কোতোয়ালের পঞ্চাশজন প্রতিরক্ষী তাফাখুরের বাড়ি পাহারা দিক যাতে এই আস্তিনের সাপটি তার গর্ত থেকে না পালাতে পারে। (কবিতা)
এই ধরণের শয়তানিতে ভরপুর অপদার্থ সন্তানেরা / প্রখ্যাত অভিজাত পরিবারের পিতামাতার সম্মান ধুলোয় মিলিয়ে দেয়।
এক্ষুনি, প্রধানমন্ত্রী ‘নির্দেশক্রমে চিঠি’ লিখবে, সেটির মুখ বন্ধ করার ও সম্রাটের সামনে পেশ করার আগে সম্রাটের বয়ানে একটা চিঠি আকিল খাঁয়ের সামনে পেশ করবে। এই চিঠিটির বিষয়টা হল, ‘আমার প্রিয় অনুগ্রহশীল বন্ধু, সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের দাবিতে আমি বিশ্বাস করি পারি যে তুমি দুর্বৃত্ত তাফাখুরের আত্মীয়(আঙ্কল)। যদি তুমি একজন খোজা পাঠিয়ে তাকে তোমার সামনে ডেকে এনে তাঁকে নগ্ন করে পঞ্চাশ ঘা চাবুক মারতে তাতে তোমার ভাইয়ের হৃদয় হয়ত শান্তি পেত। চাবুকের রাজসিংহাসন, আমার বুকের পোঁতা হৃদয়কে বার করে নিয়েছে(আমার নাতির কাজে)’।
এটি পাঠ করে সম্রাট লিখলেন, ‘আমার মামীর কন্যার পুত্রকে কেউ আঘাত করতে পারে না। আমার জীবন যদি ততদিন থাকে, এবং মৃত্যু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছা অনুসারে আমি তাঁকে আমার হাতে পেটাই করব। সে আমার পুত্রসম। কিন্তু সন্তান যদি দুর্বৃত্ত হয় তাহলে (সে রকম)সন্তানের প্রয়োজন কি? দাসকে আঘাত করার অর্থ তার মনিবকে অপমান করা(অন্য একটি পাণ্ডুলিপিতে আছে, ‘লেখার আর মুখে বলার যে মর্যাদা আমরা দিচ্ছি(তাফাখুরের বিষয়ে) তা একটি প্রবাদের অনুসারী, ‘দাস পেটানোর অর্থ, মালিককে অসম্মান করা’। একজন দারুণ সম্পর্ক সংযোগ রক্ষা করা অভিজাত যদি খারাপ কাজ করে, সেই অপমান আমরা রাখব কোথায়?’)।
মন্তব্য – আসাদ খাঁ সাম্রাজ্ঞী মুমতাজ মহলের চার বোনের একজনকে বিবাহ করেন, সেই সম্পর্কে তিনি আওরঙ্গজেবের মামা। আসাদ খাঁয়ের অন্যান্য প্রখ্যাত উত্তরাধিকারীর সম্বন্ধে বিশদে বলা হয়েছে মাসিরউলউমারায়। তাফাখুরের বন্দীত্বের সূত্র পাওয়া যায় আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্রে, এনায়েতুল্লার আহকমইআলমগিরিতে। আর ১৬৮২তে ঢাকায় তাফাখুরের মাতলামোর সূত্র পাওয়া যায় ব্রিটিশ এজেন্ট হেজেসের ভ্রমণকাহিনীতে(হেজেস, ডায়েরি)। বাকসারিয়া বা বক্সারের হিন্দু তোপদাগা সৈন্যদের কথা এখানে বলা হচ্ছে, আজকে এদের বলা হয় ভোজপুরি। এই অঞ্চল বহুদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জমিদারদের বন্দুকবাজ এবং লাঠয়াল সরবরাহ করেছে। আকিল খাঁ, উপাধি রাজি, ১৬৮০ থেকে ১৬৯৬ পর্যন্ত দিল্লির সুবাদার ছিলেন। নোয়ার দায়িত্বহীন পুত্রের নাম ক্যানন। ‘নোয়া তার মদ্যপান থেকে উঠে বুঝলেন তার ছোট ছেলে তার কি হাল করেছে। এবং তিনি বললেন, ক্যাননকে অভিশাপ দাও’।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment