চতুর্থ খণ্ড
শিয়া আর হিন্দুদের প্রতি তাঁর নীতি
৬৯। সুন্নি পাত্র, সিয়া গোষ্ঠীর কন্যাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করল
রুহুল্লা খাঁ তার মৃত্যু শয্যায় কাজি আবদাল্লার উপস্থিতিতে একটি ইচ্ছাপত্র করে গিয়েছিলেন। তার একটি ধারা হল, ‘আমি একজন সুন্নি, আমি আমার পূর্বপুরুষের (শিয়া)ধর্মাচরণ থেকে নিজেকে বিচ্যুত করে নিয়েছি। দয়া করে আমার দুই কন্যাকে সুন্নি(পাত্র)র হাতে তুলে দেবেন’। কাজি এই বিষয়টি সম্রাটকে জানালেন। তিনি লিখলেন, ‘তাকিয়া(সুচারুরূপে ধর্ম-বিশ্বাস লুকানো) সারা জীবন ধরে মেনে চলার বিষয়, কিন্তু নিজের মৃত্যু শয্যায় এই ধরণের ধর্মীয় ভণ্ডামি একটি অভনব উদ্যম! আমার ধারণা (সে এই কাজটি করেছে) তাঁর সন্তান আর আত্মীয়দের বাঁচাবার জন্য। তার ভণ্ডামির মুখোশ খুলবে যদি তার সন্তানেরা এই(তার বর্ণিত) পথ অবলম্বন করে। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তুমি কাজ করবে। তার বড় মেয়েকে শাহজাদা মুহম্মদ আজিম আর ছোটটিকে সিয়াদত খাঁকে অর্পন কর’। পরের দিন সিয়াদত খাঁ বললেন, ‘এই বংশানুক্রমিক সেবক (রুহুল্লা খাঁএর কন্যাকে) বিয়ে করতে অনিচ্ছুক। কি করে জানব সে সুন্নি হয়েছে কি না। সে যদি নিদের (ধর্ম)বিশ্বাসে অটল থাকে তাহলে কি হবে?’
মন্তব্য – প্রথম রুহুল্লা খাঁ, খালিউল্লা খাঁ আর হামিদা বানুর পুত্র। ১৬৮০ থেকে মৃত্যু(যতদূর সম্ভব ১৬৯২) পর্যন্ত বক্সী(খাজাঞ্চি)র পদ অলঙ্কৃত করছেন। ১৬৮৬র সেপ্টেম্বরে বক্সির কাজের সঙ্গেই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বিজাপুরের সুবাদার নিযুক্ত হন। তার এক কন্যা বাহাদুর শাহের কন্যা শাহজাদা আজিমকে বিবাহ করেন ২৬ জুন ১৬৯২ সালে। যুবা সিয়াদত খাঁ উপাধি দেওয়া হয় সিয়াদত খাঁ সঈদ উগজলানের পুত্রকে ১৬৯৮ সালে। খ্বাজা আবদুল্লা(মহম্মদ শরিফের পুত্র) রাজসভার কাজি নিযুক্ত হন মে ১৬৮৫ সালে।
৭০। রুহুল্লা খাঁএর মৃত্যু এবং শেষকৃত্য
রুহুল্লা খাঁ যখন মৃত্যু শয্যায়, সম্রাট তাঁকে দেখতে গেলেন। তখন তার জ্ঞান নেই। জ্ঞান ফিরে এলে সালাম জানিয়ে নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করেনঃ
কোন গর্বে এই প্রার্থনাকারী এই বিশ্ব ছেড়ে যাচ্ছে/ আপনি তার মৃত্যুর সময়ে এই সেবকের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সম্রাটের চোখ ভেঙ্গে জল বয়ে গেল, বল্ললেন, ‘সর্বশক্তিমানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় না। ভাল হয়ে ওঠা আর আশা তারই দয়ার(বা ক্ষমতার) বাইরে নয়। কিন্তু মৃত্যু প্রত্যেক মানুষের জীবনে নেমে আসে, তোমার হৃদয়ের ইচ্ছের কথা বল, আমি নিশ্চিতভাবে তা পূরণ করব’। রুহুল্লা খাঁ তার হাত বাড়িয়ে সম্রাটের পায়ে বুলিয়ে বললেন, ‘এই পায়ের শরণ আমি সারাজীবন পেয়েছি। আমি এখন শুধু প্রার্থনা করব যাতে আমার পুত্ররা মহামহিমের শিক্ষার স্নেহচ্ছায়া থেকে বঞ্চিত না হয়, যদি যোগ্য মনে হয়, তাহলে তাদের কোন দপ্তরে নিযুক্ত করতে পারেন, আর তারা যদি আয়োগ্য হয়, তাহলে তাদের পূর্বজদের সেবার কথা স্মরণে রাখবেন’।
সম্রাট উত্তর দিলেন, ‘আমার জীবন এবং হৃদয় দিয়ে আমি এইগুলি সমর্থন করি’। তখন রুহুল্লা খাঁ আবার বললেন, ‘আমার দুই কন্যার বিবাহের বিষয়ে আমি নাজিরের মাধ্যমে আপনাকে একটা আবেদনপত্র পাঠিয়েছি, আমি ধার্মিকভাবে সুন্নি মতাবলম্বী, আমার পূর্বজদের (সিয়া)মত আমি পরিত্যাগ করেছি; আমার আবেদন দুজনকেই আপনি দয়া করে উচ্চবংশের কোন সুন্নি গোষ্ঠী জাত পাত্রের হাতে দান করবেন। আর আমি শেষ বারের জন্য আবেদন করছি, আপনি মহামহিম, কাজি মুহম্মদ আক্রমকে নির্দেশ দেবেন, তিনি যেন আমার কবরে শেষ চাদরটি চড়াতে পারেন’। সম্রাট মাথা নামিয়ে মৃদু হাস্য করে জানালেন, ‘সত্য, সন্তানদের প্রতি তোমার এই প্রেম আমায় নিঃসহায় করেছে। তোমার জ্ঞান আর ফন্দির কাছে আমি কোনদিন আত্মসমর্পণ করিনি। মনে হয় তুমি পরিকল্পনা করেছিলে, সুন্নী হৃদয়ের প্রতি ভালবাসায় আমি তোমার সন্তানদের প্রতি সদর্থক মনোভাব পোষণ করব। কিন্তু এই পরিকল্পনাটা তখনই খাটবে যদি সক্কলে একই (সুন্নি)মনোভাব পোষণা করে। কিন্তু তারা হয়ত তা করবে না। তবে আমি তোমার শেষ ইচ্ছেটি পূরণ করব কোরানি আইন অনুযায়ী’। তারপর তিনি কোরাণ(ফাতিহা) আবৃত্তি করে চলে গেলেন।
রুহুল্লা খাঁএর মৃত্যুর পর কাজি এলেন তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী। জনৈক ব্যক্তিগত ভৃত্য আকা বেগ তাঁকে রুহুল্লা খাঁএর লেখা এবং সিলমোহর করা একটা চিঠি দিলেন, যাতে বলা হয়েছে, ‘আমায় কবর দেওয়ার সময় এই বিনীত মানুষটির শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী এবং সম্রাটের নির্দেশক্রমে যদি কাজি আসেন, তাহলে তার কাজ সম্পন্ন করার কাজে সহায়তা করবে আকা বেগ। মহামহিম পুণ্যবান কাজিকে এই গরীব মানুষটি তার শেকৃত্য করার বোঝা বইতে দিতে চায় না। আর কাজি আমার বাড়ীতে এসেছেন, এতেই আমার মত পাপীর পুণ্যলাভ হয়ে গিয়েছে’।
এই আকা বেগ, আকা এবং বেগ, এই দুই উপাধি ধারণ করে ভৃত্যের মত থাকলেও সে কিন্তু আদতে একজন শিয়া ধর্মতত্ত্ববিদ। আকা বেগের জ্ঞান, ভয়শূন্যভাবে তত্ত্ব আলোচনা করার রীতি এবং পড়াশোনার ব্যপ্তি তার সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন কাজি। কাজি চিঠিটি পড়েই রুহুল্লা খাঁএর পরিকল্পনা বুঝেছিলেন – অর্থাৎ তাঁকে ডেকে তাঁকে স্তোক দিয়ে(শাকিইখুশতবাই) এনে তার সামনে পারলৌকিক (ধোয়ার) কাজটি আকা বেগকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া। অখুশি হয়ে কাজি তারর সভার সংবাদ লেখক মুহম্মদ ঘাউসকে বললেন, এক্ষুনি একটা সংবাদ লিখে ফেল এবং তৎক্ষণাৎ সেটি কোন দাসের হাত দিয়ে সম্রাটের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দাও যাতে অতিশীঘ্রই তিনি তার মন্তব্য জানতে পারেন।
যখন সেই লেখাটি সম্রাটের হাতে পৌঁছল, তিনি লিখলেন, ‘তার মৃত্যু শয্যায় (সে যা বলেছে তাতে) তার আগের কৃতকর্মের ওপর গভীর কালো ঘৃণার পর্দা ফেলে দিয়েছে। কাজির আর ওখানে থাকার প্রয়োজন নেই। তার জীবনে তার ভাবনা, বিশ্বাস লুকিয়ে দ্বৈত জীবন যাপন করেগিয়েছে। তার মৃত্যুতেও সেই অভ্যাসের চরিত্র বদলায় নি। অন্য কারোর বিশ্বাসের ওপর আমার কি হাত থাকতে পারে? যিশু আর মোজেস তার নিজের ধর্ম (নির্বিবাদে)পালন করুণ। তার কন্যার হাত সুন্নী পাত্রের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব একটা সুচতুর পরিকল্পনার অঙ্গ, যাতে সেই ভাগ্যহীন অভিজাত তার পরিকল্পনায় সামিল হয়ে(তার কন্যাকে বিবাহ করে) নিজের সর্বনাশ করে, যাতে সে তার পত্নীর প্রতি প্রেমে তার দীর্ঘদিনের বিশ্বাস থেকে সরে গিয়ে নব্য শিয়াত্বে দীক্ষা লাভ করতে পারে। সর্বশক্তিমান আমাদের হৃদয়ের নষ্টামি আর আমাদের কাজের পাপ থেকে রক্ষা করুণ’।
মন্তব্য - ফাতিহা হল কোরাণের খুব প্রচলিত মাত্র সাতটি কবিতার অধ্যায়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment