তৃতীয় খণ্ড
৩৮। কর্মদক্ষতাই দপ্তর চালানোর একমাত্র যোগ্যতা
বিলায়েত থেকে ভারতে প্রথম এসে মুহম্মদ আমিন খাঁ পাঁচশ ঘোড়ার মনসবের অনুমতি পেলেন একটি বিবেচনায়, বলখের যুদ্ধে তার পিতা, শাহেনশা আলমগিরের যথেষ্ট সেবা করেছিলেন। সময় বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদন্নোতি পেলেন, তার সুনাম হল। ন্যুনতম তিন হাজারি মনসবও অর্জন করলেন। আর চিরশত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাতারা এবং অন্যান্য এলাকা থেকে মুঘল দখলি এলাকায় সৈন্যবাহিনীর পশুদের জন্য পশুখাদ্য(খাই) এবং রসদ যোগাড় করার জন্য সুনাম এবং নওবত বাজানোরও অনুমতি পেলেন। সম্রাটের ইচ্ছে ছিল, তিনি মূল মুঘল শিবির থেকে দূরে থাকবেন, এবং কিছু সময়ের জন্য নওবত বাজানোর অনুমতি পাবেন। তিনি বললেন, ‘আমি সংবাদ লেখকদের সূত্রে জানলাম যে বাংলা থেকে যে রাজস্ব আসছে, সেটি নর্মদা পেরোচ্ছে। তুমি যাও এবং আওরঙ্গাবাদের অপেক্ষা কর, তোমার প্রচুর দৌড়োদৌড়ি হয়েছে। তার থেকেও তুমি বিশ্রাম পাবে এবং তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা নওবতও বাজাবার সুযোগ পাবে’। নিজের গায়ের একটা ফার দেওয়া ঢিলে ঘোড়া চড়ার জন্য আংরাখা দিয়ে তাকে সাময়িক যুদ্ধের কাজ থেকে নিরস্ত করলেন।
খাঁ যখন শর্মহায়াহীন মারাঠাদের পরাস্ত করে রাজস্ব নিয়ে ফিরে এসে তা সুরক্ষিতভাবে সরকারি রাজস্বভাণ্ডারে পেশ করলেন, মহামহিম এই সম্ভ্রম উদ্রেককারী সেনাপতিকে সোনায় মোড়া ঘোড়া, কালিগি সহ একটি ছোরা, এবং সম্মানীয় খেলাত দিলেন। তিনি মুহম্মদ আমিন খাঁ দেখলেন পরপর এই সম্মানগুলি তার কাছে আসছে, তিনি মুহরম খাঁ মার্ফত একটা আবেদন করলেন সম্রাটের সমীপে, ‘এই পুরাতন ভৃত্যকে বলখের যুদ্ধে তার অনুগত সেবার জন্য যে সম্মান আপনি অর্পন করেছেন, সে আপনার কাছে কিছু অনুগ্রহ প্রার্থনা করে; কিন্তু চারদিকে তার বিপুল সংখ্যক শত্রু এবং রাজসভায় হাতেগোণা বন্ধু থাকায় সে এতদিন সাহসভরে আবেদন করে, আপনার সামনে তার ইচ্ছে পেশ করতে পারে নি। কিন্তু এখন সর্বশক্তিমানের প্রতি আস্থা পেশ করে এই আবেদনটি পেশ করছে’।
আবেদনের নকল, ‘অভিবাদন! এই বিশ্বের সন্ত এবং ধর্মীয়গুরুরা এবং মানুষেররা! দুটি বকশী/খাজাঞ্চি পদ দেওয়া হয়েছে বিধর্মী দৈত্যচরিত্রের পারসিদের, এবং যদি সেদুটির একটাও এই পুরাতন এবং বিশ্বস্ত ভৃত্যকে দেওয়া যায়, তাহলে (সুন্নি)বিশ্বাসকে আরো জোরদার করা যায়, এবং অবিশ্বাসীদের থেকে একটা অন্তত চাকরি কেড়ে নেওয়া যায়। ‘ও বিশ্বাসী, বন্ধুকে নিজের এবং শত্রু করে নিওনা’।
আবেদনপত্রের প্রান্তে আওরঙ্গজেব লিখলেন, ‘তুমি তোমার দীর্ঘদিনের যে সেবার কথা বলেছ, সেটা সত্য। আমি যতিদূর সম্ভব সেটাকে গুণ হিসেবে দেখার চেষ্টা করছি। আর পার্সিদের মিথ্যা ধর্ম নিয়ে তুমি যে লিখেছে, (আমার উত্তর) – কাজের সঙ্গে ধর্মের কি সম্পর্ক? আর ধর্মের সঙ্গে গোঁড়ামির সম্পর্ক কোথায়? তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার। আর ধর্ম সম্বন্ধে যদি তোমার অভিযোগ সত্য হত, তাহলে হিন্দুস্তানের সব হিন্দু রাজা এবং তাঁদের অনুগামীদের মুলোতপাটন করতে হত। কাজের আমলাদের দপ্তর থেকে হঠানোর কাজ জ্ঞানী মানুষেরা করে না। বক্সী বা খাজাঞ্চি পদে তোমার আবেদনের যোগ্যতা আছে কেননা তার তুলনীয় পদে তুমি এখন কাজ করছ। এর পিছনে যে কারণটা কাজ করছে তা হল তুরাণীরা তোমার অনুগামী, আমার পূর্বপুরুষ যে শহর থেকে এসেছেন, তারাও সেই শহরের – একটা প্রবাদ আছে, নিজের হাতে নিজের ধ্বংস ডেকে এনো না – ভয়ঙ্কররূপে চলা যুদ্ধের মাঝে কেন এমন ভাব না? লুণ্ঠনের মত অভিযানে এই ধরণের মানসিকতায় কোন বিপদ নেই, কিন্তু যুদ্ধের মাঝে যদি এ ধরণের চিন্তা পেয়ে বসে তাহলে ভয়ানক কাণ্ড ঘটবে। সর্বশক্তিমান না করুক! কোন সম্রাটের যদি এই চিন্তা পেয়ে বসে, তাহলে সেই মুহূর্তে তার সব শেষ হয়ে যাবে।
তুমি যদি এই ধরণের কাজ না করতে চাও বা পিছিয়ে যেতে চাও – তাহলে আমায় বিশদ জানিয়ে লেখ। যে সব পার্সি বিলায়েতে বা হিন্দুস্তানে জন্ম হয়েছে – এবং যারা তাঁদের মুর্খতার জন্য বিখ্যাত – তাঁদের এই ধরণের কাজ থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।(কবিতা)
বিচার দাও, খারাপ কাজের নির্বুদ্ধিতার,/ ধূর্ত শৃগালের চরিত্রের হাজার মস্তিষ্কের থেকে ভাল,/একটা মাথা সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট,/শত্রুর ছোঁড়া ঢিল শত্রুর চোখে মারার কাজে।
মন্তব্য – মুহম্মদ আমিন খাঁ, কুইলচ খাঁএর ভাই, মীর বাহাউদ্দিনের পুত্র, বুখারা থেকে ভারতে আসেন ১৬৮৭ সালে। চিন বাহাদুর উপাধি পান নভেম্বর ১৭০৬, ১৬৯৮তে সদর পদ। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময় তিনি চারহাজারি মনসবদার(১৫০০ সৈন্যের) ছিলেন। তার মুঘল অনুগামীদের তালিকার জন্য মাসিরউলউমারা দেখুন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment