চতুর্থ খণ্ড
পূর্বে সিল্ক পিস গুডস বিষয়ে যে আলোচনা করেছি, যেমন ব্যান্ডানোজের সাধারণ এবং বহুমূল্য বৈচিত্রের রেশমের সিল্ক লুঙ্গি রুমালের ওপরে অগ্রিমের হার ৭৬ থেকে ৮০% পর্যন্ত ওঠাপড়া করত। সাধারণ এবং ডোরাকাটা টাফটের ওপরে দাদনের ওঠাপড়া হত ৬৯ থেকে ৭৫% এবং দানাদারে ৭১ থেকে ৭৭%। চাদরবাঁধনি ৮২% এবং জামদানির ওপর দাদন ছিল ৮৯%। গুরায় দাদন ৭০ থেকে ৮৫% এবং দোসুতির ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৭০%।
কোরা রেশম এবং সিল্ক পিস গুডস সব থেকে চাহিদাবন্ত লাভের পণ্য যেহেতু প্রায় প্রত্যেক ব্যবসায়ীই এই ধরণের পণ্য কিনতে চাইতেন। এই ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন বিনিয়োগের, বলা ভাল তাদের ব্যবসার রোজগারের দিকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করা যাক।
বিদেশি কোম্পানিগুলির তথ্যসাবুদ থেকে বুঝতে পারি যতক্ষণ তাদের লাভের হার না কমছে ততক্ষণ তারা ব্যবসায়ীদের ভাল কি হল না হল, বা বেশি হল কি না, সে সব বিষয়ে দৃষ্টি দিত না। অনেক খুঁজে পেতে আমরা ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে কাশিমবাজার রেশমের ব্যবসায়ে বোধহয় দাদনি বণিকদের লাভের হারটি বুঝতে পেরেছি।
দাদনি বণিকদের রোজগারের হার কি ছিল? ১৭৪১এর ২৯ এপ্রিল যে রেশম বস্ত্রের নমুনায় যা দেখানো হয়, শেষ পর্যন্ত কিন্তু সেই গুণমানের রেশম বস্ত্র সরবরাহ করা হয় নি। এবং কোম্পানি ঠিক করে তারা একজন ফ্যাক্টরকে কুমারুলি আড়ংএ পাঠাবেন এই বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। তারা সেখানে গিয়ে যা বুঝলেন, ব্যবসায়ী দরকষাকষি করে যে দাম ঠিক করেছেন, পরে তিনি দেখেন তিনি সেই দামে সেই গুণমানের বস্ত্র সরবরাহ করতে অপারগ। এবং তার পরেও ব্রিটিশেরা কিন্তু নতুন করা দাম নিয়ে দরাদরি করে নি।
সেই বছরের ব্যবসায়ীরা রংপুর রেশমের দাম দাবি করে ৫.৭৫ টাকা প্রতি সের, যার মধ্যে ১.৯% দালালি এবং ৪.২ শতাংশ কোম্পানির বাটা। ৬ জানুয়ারি, ১৭৪২ সালে পরামর্শদারারা দেখেন যে রংপুরের রেশম তৈরি হয়ে কোম্পানির গুদামে যখন দামের জন্য ওঠে, তখন কোম্পানি দেখল সেটার প্রতিসেরের উতপাদন খরচই হয়েছে ৫.৭০ টাকা। এই দামটি নতুন করে ঠিক করা হল পিরোনো দামের সঙ্গে মিলিয়ে। শীতের (নভেম্বর) উতপাদনের প্রতি সেরের দাম হয়েছে ৫.৪০ টাকা, এবং ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের থেকে ৫.৭৫ টাকা দাবি জানায়। কোম্পানি তথ্য অনুযায়ী আমরা দেখতে পেলাম বণিকের থাকত ১ থেকে ৬ শতাংশের আশেপাশে।
বাস্তবে উতপাদনের খরচের ওপর ব্যবসায়ীদের লাভ ২ থেকে ৪%র মধ্যে থাকত। ৬ এপ্রিল ১৭৩৭এ কোরা রেশমের জন্য ব্যবসায়ীদের রোজগার হয় চার আনা(২৫ পয়সা) প্রতি সের এবং প্রত্যেক সিল্ক পিস গুডসএর জন্য ১ থেকে ৩ আনা। আমরা যদি ধরে নিই ৪০ সেরে ১ মন হয় এবং এক একজন ব্যবসায়ী ২০০ মনের বরাত পায়, তাহলে রোজগার সম্বন্ধ্যে একটা মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা করা যেতেই পারে।
ফলে ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে দালাল হিসেবেই কাজ করছে; শুধু কোম্পানিদের ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত ইওরোপিয় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। ১৭৩০ থেকে বাংলায় কোম্পানি আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা কিছুটা হলেও কোম্পানির প্রতিযোগী হয়ে উঠতে থাকে, ফলে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের নিজস্ব ব্যবসার বেনিয়ান হিসেবে দাদনি বণিকদের রোজগারও খুব কম ছিল না।
১৭৩৩ সালে লন্ডনের কোম্পানির নির্দেশকেরা বুঝতে পারলেন, যেভাবে ব্যক্তিগত ব্যবসা বাড়ছে, তাতে প্রতিযোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে; সেই প্রবণতা আটকাতে কোম্পানি কাশিমবাজারে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই জয়েন্ট স্টক কোম্পানিটি কাশিমবাজারে চালু হয় ১৭৪৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে।
এই ব্যবসার শাখাটি বাড়বাড়ন্ত হয়, কেননা এই ব্যবসাটির মাঝেমধ্যেই উল্লেখ পাচ্ছি কোম্পানির নিজস্ব হিসাব রাখার বইতে বিভিন্ন ব্যক্তিগত দালাল এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের নামোল্লেখে। হারাণ বিশ্বাস ছিলেন স্যামুয়েল হিলচ্যাম্পের বানিয়ান, কিশোর বিশ্বাস, অতিরাম ওয়েন্ট বারোয়েলকে পণ্য সরবরাহ করতেন। ১৭৩৭ সালে হুটু কোটমার নাম উল্লিখিত হয়েছে একজন ব্যাঙ্কারের জুয়াচুরির সঙ্গে জুড়ে থাকার জন্য।
ব্যাংকারদের খুব কাছের দালাল ছিলেন কোটমারা। কাশিমবাজার গুদামে ১৭৩০ এবং ১৭৩৩এ বালি এবং হুতু কোটমা ছিল সেই ব্যাঙ্কারের বানিয়ান। অন্যান্যদের নাম হল উদয় কুশল, রঙ্গনাথ বিশ্বাস এবং কুশলচাঁদ। ১৭৪১এ দেখাযাচ্ছে একজন ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী আয়রের নিজস্ব দাদালের নাম ছিল নিমদাস।
কোম্পানিকে পণ্য সরবরাহ করা ছাড়াও এই ব্যবসায়ীদের আরও একটা কাজ ছিল, বিভিন্ন ইওরোপিয় ফ্যাক্টরি কুঠি থেকে ইওরোপিয় পণ্যের ক্রেতা ছিল। এই পণ্যগুলি বিক্রি করে কোম্পানি বাংলায় তাদের ব্যবসার কিছুটা বিনিয়োগ জোগাড় করত। এই পণ্যগুলি তার পর বিভিন্ন জেলার দাদালদের বিক্রি করত ব্যবসায়ীরা।
এইসব কুঠীর বিভিন্ন ইওরোপিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভাল
চাহিদা ছিল বাংলায়, এছাড়াও ইওরোপিয় পশমি বস্ত্রেরও চাহিদা ছিল। ১৭৪০ সালে হুটু
কোটমা বিভিন্ন পশমের তৈরি বস্ত্র খরিদ করে, ১৭৪১এ কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি পশমের
বস্ত্র বিক্রি করে সাউতু কোটমা, এবং বিশ্বাস পরিবারের নরেন, কুলিয়ান, রঙ্গনাথ এবং
হেমো পোদ্দার, ধর্মদত্ত, কুশলচাঁদ, আলুমচাঁদ এবং শর্মা গোষ্ঠীর মধ্যে
মাউদেব(মহাদেব?), সবরাম এবং কেবলরাম। এছাড়াও ফতেচাঁদ জগতশেঠ এবং তার নাতি
মতুবরায়কেও বিক্রি করে। শেষের দুজন ছাড়া প্রত্যেকে কিন্তু কোম্পানির খাতায়
উল্লিখিত ব্যবসায়ী।
এই নামগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি, কাশিমবাজারের
অন্যান্য ব্যবসায়ীর তুলনায় এই ব্যবসায়ীরা একটু হলেও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসার
ক্ষেত্রে সুবিধাভোগের অবস্থায় ছিলেনঃ এই তথ্য পাচ্ছি বিভিন্ন পরামর্শদানের
উদ্ধৃতির সূত্রে। তবে প্রত্যেক ব্যবসায়ীর রোজগারের হার ছিল প্রায় একই রকমের, যদিও
মোট রোজগার সবার এক পরিমানে হত না, সেখানে তারতম্য থাকত, সেটাও পরামর্শ সূত্রে
জানা যাচ্ছে। কাশিমবাজার ব্যবসায়ীদের মধ্যে পণ্য সরবরাহের বৈচিত্রের এবং ব্যক্তিগত
ব্যবসার মোট ব্যবসা দেখাশোনা করার ক্ষেত্রে, রোজগারের তারতম্য বেশ ভালই ছিল, এবনফ
এর ফলে গোষ্ঠীর(কোর্টরি) উদ্ভব ঘটে।
{চতুর্থ খণ্ড সমাপ্ত}
(চলবে)
No comments:
Post a Comment