দ্বিতীয় খণ্ড
আজম খাঁ
১৭। পারলির আত্মসমর্পন
পারলির দুর্গের অবরোধ চলেছিল দীর্ঘদিন ঘরে, চার মাস। এবারে বর্ষা কাল ঘিরে এল। সেই এলাকায় বর্ষার সঙ্গে আসে পাহাড়ি ঝড়। অবস্থা নিরিখে অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সেনারা হুঁশিয়ার হয়ে রয়েছে। এমত সময়ে শেখ শাদুল্লা খাঁ, মুহরম খাঁএর মাধ্যমে সম্রাটকে পরামর্শ দিলেন, ‘যদি সম্রাটের সন্তান আলিজা ক্ষুণ্ণ না হন, তাহলে এক দিনের মধ্যেই শান্তি আনা যায়’। সম্রাট বললেন, ‘এক দিন অপেক্ষা কর; কাল এই প্রশ্নের উত্তর দেব’। সন্ধ্যে বেলা বোঝা গেল, শাহজাদার শান্তির পক্ষে নন, এ বিষয়ে তার অত্যন্ত অনীহা; এবং শেখ, দুর্গের আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছে একটি শর্ত মেনে যে, সেনাপতি এবং সেনা বাহিনী নিরাপদে যাতে বেরিয়ে যেতে পারে(কোন সম্পত্তি বহন করা ছাড়াই)। সম্রাট বললেন, ‘ব্যবস্থা করে ফেল। আমার আদেশ পাওয়া মাত্রই যেন দূর্গের মাথায় আমাদের পতাকা উড়তে শুরু করে’। তার নির্দেশক্রমে সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে সভা বসেছে, সম্রাট শাহজাদাকে বললেন, ‘আমায়, তোমার মনের অবস্থার প্রতি সাম্মান জানাতেই হবে। কিন্তু শান্তি বয়ে আনা খুব বড় কাজ হবে না। সকলেই এটা করতে পারে’। শাহজাদা উত্তর দিলেন, ‘সম্রাটের পরিকল্পনায় যে কাজ হবে, আমি সেই কাজে মত দিতে প্রস্তুত’। সম্রাট প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘তারপর তুমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে’। শাহজাদা উত্তর দিলেন, ‘এই দাসের কি ক্ষমতা আছে, যে আপনার মত ধর্মগুরুর পূণ্য নির্দেশ অমান্য করে?’ (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে)শাহজাদা প্রশ্ন করলেন, ‘শান্তির মধ্যস্থতা কে করছেন?’ ‘শেখ শাদুল্লা’ সম্রাট উত্তর দিলেন। সে সময় সভায় শাদুল্লা উপস্থিত ছিলেন না, সম্রাট মুহরম খাঁকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ‘দূর্গের মাথায় খুব তাড়াতাড়ি (আমাদের) পতাকা তুলতে শাদুল্লা খাঁকে এতেল্লা পাঠাও’। দুঘড়ির পর পতাকা উঠল এবং বিজয় সঙ্গীত বাজতে শুরু করল। শাহজাদা আজম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে কঠোর স্বরে বললেন, ‘যেহেতু সেই পাজিটা আপনার পরামর্শদাতা হয়েছে, আমরা আপনার দাস, কিন্তু আমাদের এবারে পক্ষ নিতেই হবে’। সম্রাট উত্তর দিলেন, ‘আমি বদমায়েস শয়তানদের পছন্দ করি। আমি এখুনি দুটি শয়তানকে এই শিবির থেকে তাড়িয়ে দেব, শেখ শাদুল্লা যাবে মূল শিবিরে আর তুমি যাবে গুজরাট সুবায়’। তিনি সেই ক্ষণে দণ্ডধারীদের দারোগা সাদাত খাঁকে নির্দেশ দিলেন সেই মুহূর্তে তার দণ্ডধারী বাহিনী এসে যেন তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে সাপগাঁওতে নামিয়ে দেয়। সাম্রাজ্যের ৩ কোসে সেনা শাহজাদাকে তার বর্তমান বাসস্থানে না যেতে দিয়ে তার সঙ্গে যায়। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে পর্দা ফেলে দিয়ে সভা শেষ করে দেন। শাহজাদা আজম বুঝতে পারছিলেন না কি করা দরকার এবং নিরুপায় হয়েই উজির আজম খাঁকে তার আর তার পিতার মধ্যে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করলেন; উজির সম্রাটের কাছে শাহজাদার জন্য দু দিনের সময় চাইলেন, যাতে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলে তার আদেশ কার্যকর হয়। সম্রাট উত্তর দিলেন, ‘আমার ভৃত্যের কোন অধিকার আছে আমার আর আমার পুত্রের কথাবার্তার মধ্যস্থতা করে?’ এই অনুরোধ করায় আসাদ খাঁ খুব লজ্জিত হলেন। শেষ পর্যন্ত দণ্ডধারীরা সাতগাঁওতে শাহজাদার বাসস্থান উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় (শাহজাদা) বললেন, ‘আমাদের কাছে তেল-কাপড় তৈরি করার মত মোম নেই’। আওরঙ্গজেব উত্তর দিলেন, ‘তুমি সরকারি ভাণ্ডার থেকে তার দাম দিয়ে সেগুলি নিয়ে যাও’। শাহজাদা বললেন সেই অর্থ তার জলপানি থেকে কেটে নেওয়া হোক। সম্রাট তার আবেদনের ওপর লিখলেন, ‘কোন জ্ঞানী মানুষ ঋণে পণ্য বিক্রয় করে না, কে জানে কে কতদিন বেঁচে থাকে, কে কবে মারা যায়। তুমি নগদে অর্থ দিয়ে মোমটি কিনে নিয়ে যাও’। শাহজাদাকে সেই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হল; তিনি ১২০০ টাকা দিয়ে সেই মোম কিনে নিলেন।
মন্তব্য – পারলি দুর্গ সাতারা থেকে ৪ কিমি দূরে। ১৭০০ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ৯ জুন পর্যন্ত এই দুর্গটি আওরঙ্গজেব অবরোধ করেন(সূত্রঃ মাসিরইআলমগিরি)। শাহজাহা আলিজা হলেন মহম্মদ আজম, আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র। শেখ শাদুল্লা হলেন, এক সময়ের সম্রাটের ব্যক্তিগত সাহায্যকারীদের(খাওয়াস) মুশরিফ। দণ্ডধারীরা সম্রাটের ব্যক্তিগত নির্দেশ পালন ও গ্রেপ্তার করে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment