তৃতীয় খণ্ড
জাফর খাঁএর পুত্র কামগার খাঁ সম্রাটকে নিবেদন করলেন, ‘ব্যঙ্গরসে ভরপুর বিষপূর্ণ চরিত্র মির্জা মুহম্মদ নিয়ামত খাঁ, আমার বিবাহ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিবাহের উদ্দেশ্য হল এটি একটি আইনি ক্রিয়া, যেখানে দুটি নিশ্চল/যৌনঅক্ষম (যদুনাথ ইংরেজিতে লিখেছেন, quiescent) ব্যক্তি মিলিত হয়’। এছাড়াও তিনি আমার সম্বন্ধে অনেক বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, যাতে জনগণের মাঝে আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। আমার আশা, মহামহিম, সেই ব্যক্তিটিকে উচিত শাস্তি দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে সে আর এ ধরণের ঘৃণিত কাজে না অগ্রসর হওয়ার ভাবনা ভাবতে পারে। এই উপযোগী বিষয়টি আমি মহামহিমের সামনে উপস্থিত করলাম’।
ওপরের আবেদনের ‘উপযোগী’ শব্দের ওপরে আওরঙ্গজেব লিখলেন, ‘এটা অনুপোযোগী(হারাম)’, এবং আবেদনপত্রের ওপরের দিকে তিনি লিখলেন, ‘তাঁকে(তোমার সামনে) শাস্তি দেওয়া আরো বড় মুর্খমি হবে। উত্তরাধিকারিসূত্রে আমার এই সাধারণ মনের আমলাটি আমায় তার শব্দের অংশিদারি করেছে; নিয়ামত খাঁ আমার বিরুদ্ধে তার ইচ্ছেমত যা খুশি লিখতে পারে; আমায় সাধারণের চোখে দুর্বৃত্ত প্রমান করতে পারে। অতীতে সে আমার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কলম শাণিত করেছে; তার প্রতিদানে আমি তার মাইনে বাড়িয়েছি যাতে সে আর আমার বিরুদ্ধে তার কলম কাজে লাগাতে না পারে; এই (প্রলোভন)কর্ম সত্ত্বেও সে কিন্তু তার (ব্যঙ্গ)কলমের গরল কমায় নি। তার জিহ্বা উতপাটন বা গর্দান নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সকলের ভাবনাকে লাগাম পরানো উচিত এবং মিলেজুলে বসবাস করা প্রয়োজন। সে এমন এক বান্দা যে কাউকে তো বটেই নিজেকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না’।
মন্তব্য – আওরঙ্গজেবের পূর্বতন উজির জাফর খাঁ এবং ফরজানা বেগমের পুত্র কামগার খাঁ, ১৬৮৭ সালে খাঁইসামান নিযুক্ত হন, সেপ্টেম্বর ১৬৮৮তে সৈয়দ মুজফফর হায়দারাবাদির কন্যাকে বিবাহ করেন। মির্জার ব্যঙ্গ রস প্রাণঘাতী। তিনি তার বয়েতে শুধু কামগারকেই বেঁধেন নি, নিয়ামত খাঁ সে সময়ের প্রত্যেক মাজাকতেই এই নববিবাহিতকে তাক করেছিলেন।
মির্জা নুরুদ্দিন মুহম্মদ হাজি নিয়ামত খাঁ, কাব্য নাম আলি, পার্সি ভিষগ হাকিম ফাতাউদ্দিন শিরাজির পুত্র। বাহাদুর শাহের অধীনে তিনি দানেশমন্দ খাঁ উপাধি লাভ করেন। তিনি বাহাদুরশাহনামা, জগনামা, ওয়াকায়ি এবং মুশাকাত লেখেন; তিনি তার সময়ে বিখ্যাততম ব্যঙ্গ কবি।
৬০। নিন্দুক শাস্তি পেল
আমেদাবাদে থাকা শাহজাদা মুহম্মদ আমন খাঁএর সেনাবাহিনী থেকে পাওয়া খবরে জানলেন মুহম্মদ বেগ,, শাহজাদার সব থেকে কাছের সেনাভিনী আহদির প্রধান, এবং অপ্রকাশ্যে অন্যান্য কর্মীদের কাজের নিন্দা করে তার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে।
মহামহিম লিখলেন, ‘সিয়াদত খাঁ একজন কঠোর দণ্ডধারীকে পাঠাও, যে এই নিন্দুককে ধরে আনতে পারবে – এই মানুষটি আমার বর্তমানে রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে, এবং এখনও সে নিজের পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, কেননা সমস্ত খারাপ কাজের থেকেও খারাপ কাজ হল পিছনে নিন্দা করা এবং অপবাদ জ্ঞানপনকরা। খুনের থেকেও ঘৃণিত কর্ম এই কাজগুলি। প্রবাদ বলে ‘সাপের চামড়া বহুরঙা, কিন্তু জিহ্বা বিষময়’, ঠিক সে রকমই নিন্দুকেরা – যাদের চরিত্র আপাত মধুর, দেখতে মাধুর্যময়, কিন্তু তার হৃদয়ে বিষে ভরা। তাদের এড়িয়ে চল! এড়িয়ে চল!’
মন্তুব্য – শাহজাদা আজমকে গুজরাটে সুবাদার করে পাঠানো হয়েছিল ১৪ নভেম্বর ১৭০১এ; ছিলেন ২৫ নভেম্বর ১৭০৫ পর্যন্ত। তার পর তিনি দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন। আহদি হল সৌন্দর্যময় সেনানীদল, অবিবাহিত, শুধু সম্রাটকে সেবা করার জন্য নিযুক্ত হত, কোন অভিজাতর সঙ্গে যুক্ত ছিল না(আরভিনএর আর্মি অব দ্য ইন্ডিয়ান মুঘলস)। চতুর্থ সিয়াদত খাঁ, তৃতীয় সিয়াদত খাঁ, সৈয়দ উঘলানের পুত্র, তার পদের নাম ছিল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব দ্য কনফার্মেশন অব পোস্টিংস, সেই পদ পান ১৬৯৯ সালে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment