দ্বিতীয় খণ্ড
১০। কে রাজাকে সঠিক উপদেশ দেয়
বাহাদুর শাহকে কারাগার থেকে মুক্ত করার পর একদিন আওরঙ্গজেব সামনে পুত্রকে
বসিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার পিতা, আমি যদি পছন্দ করি, তাহলে রাজমুকুট তোমার মাথায়
উঠবে। আমি (আমার বাবা) শাহজাহানের কাজে সন্তষ্ট নই, যেভাবে তিনি দারা শুকোর প্রতি
অনুরক্ত ছিলেন, যে মানুষটা সারা জীবন অবিশ্বাসী হিন্দু আর যোগীদের নিয়েই জীবন
কাটিয়ে গেল(তাতে আমি বিরক্ত)। বিজয় পেতে গেলে নবীদের মধ্যে সৈয়দদের(যাদের মাধ্যমে
তিনি আশীর্বাদ এবং শান্তি বর্ষণ করেন) অর্থাৎ মুহম্মদের, সাহায্য এবং বিশ্বাস
প্রয়োজন। আমি এখন তোমায় কিছু উপদেশ দেব; তুমি সেগুলি শুনবে এবং তা থেকে শিক্ষা
গ্রহণ করবে। আমি স্থির নিশ্চিত জানি যে সেগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করা তোমার চরিত্রের সম্পূর্ণ
বিরোধী, তবুও আমি বাস্তবিক স্নেহের বশে এবং যে ভালবাসা এবং বশ্যতা তুমি আমায়
দেখিয়েছে, সেইজন্য তোমায় এই কথাগুলি বলছি।
প্রথম – একজন সম্রাটকে কোমলতা এবং কঠোরতার মাঝামাঝি দাঁড়াতে হয়। এই দুটি গুণের
মধ্যে যে কোন একটা যদি অন্যটাকে ছাপিয়ে যায়, তাহলে অনেক সময় তার সিংহাসনের রশিতে
টান পড়ে যায় কেননা বেশি আন্তরিক হলে মানুষ সেই ভালবাসার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন
করে, আর যদি অতিরিক্ত কঠোর হয়, তা হলে বহু হৃদয় রুষ্ট এবং বিদীর্ণ হয়, একটা উদাহরণ
দেওয়া যাক, আমার কাকা সুলতান উলুঘ বেগ, তার ব্যক্তিমাধুর্য এবং অন্যান্য সদগুণ
থাকা সত্ত্বেও তিনি খুব রক্ত পিপাসু সম্রাট ছিলেন, খুব ছোট ছোট আধিকারিকদেরও তিনি
মৃত্যু দন্ড দিতেন। তার পুত্র আব্দুল লতিফ তাকে বন্দী করে নেহাওয়ান্দ কারাগারে
নিক্ষেপ করে। কারাগারের যাওয়ার পথে রাস্তায় তিনি একজন সাথীকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার
পতনের জন্য কে দায়ি বলে আপনি মনে করেন’? তিনি বললেন, ‘আপনার রক্তক্ষুধায় মানুষ
আপনার পাশ থেকে সরে গিয়েছে’। আমার সম্মানীয় পূর্বপুরুষ, হুমায়ুন অসাধারণ অবহেলা, গাফিলতি,
দায়ালুতা, ক্ষমাশীলতা, দৈনন্দিন কাজকর্মে দুর্বলতা, দেখিয়েছিলেন। বাংলার শাসক শের
খাঁ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার স্পর্ধা দেখালেও তিনি বার বার তার কৃতকর্মকে অবহেলা
করেছেন, এবং শুধু তার পিতা হাসান শূরকেই শুধু হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছেন, ‘তুমি তোমার
পুত্রের কাজ দেখছ, অথচ তুমি তাকে চিঠি লিখে নিবৃত্ত করছ না কেন?’ হাসান উত্তর
দিয়েছিলেন, ‘তার কাজকর্ম, চিঠি লিখে হুঁশিয়ারি দেওয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। আমি জানি
মহামহিম যে অবহেলা দেখাচ্ছেন, তার ফল কি হতে পারে’।
পরেরটি হল, সম্রাট নিজেকে হালকা করে ফেলবে না, হাল ছেড়ে দেবে না এবং কোন কাজ
থেকেই সরিয়ে নেবে না, অবসর নেওয়ার কথা ভাববে না, এই অসহ্য স্বভাবগুলির জন্যই রাষ্ট্রের
পতন ঘটে এবং সম্রাটের ক্ষমতা ধ্বংস হয়। যতটা পারা যায়, সারাক্ষণ সব কিছু নিজের
নজরে রাখবে।
(কবিতা)পরিচারক এবং সম্রাটের পক্ষে একটা স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অমার্জনীয় অপরাধ/
জল বাড়তে থাকে গলিত শবে, রাজার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়/ যে ঘুরে বেড়ায় তাকে (সকলে) রাজার
মত সম্মান করে/ ভাল আর সুখী থাকার ইচ্ছে সম্রাটকে বিশ্বাসহীন করে তোলে।
এছাড়াও বলি, তোমার ভৃত্যদের কি করে শিক্ষা দেবে সেটা তোমায়ই ভাবতে হবে, এবং যে
কাজের জন্য যে মানুষটি প্রয়োজনীয়, তাকে সেই কাজে নিযুক্ত করতে হবে। সাধারণ জ্ঞানে
বলে যে কালীন তৈরি করে, তাকে যদি কামারের কাজ দাও তাহলে কি হতে পারে ভেবে দেখবে!
বড় কাজ ছোটদের ওপর চাপিও না, কেননা বড় মনের মানুষ ছোট কাজ করতে আত্মসম্মানে আঘাত
পায়, আর ছোট মানুষের বড় কাজ করার ক্ষমতা থাকে না, সেই ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যে অরাজকতা
দেখা দিতে পারে।
মন্তব্য – মির্জা উলুঘ বেগ তৈমুরের নাতি এবং মহাজাগতিক ব্রহ্মাণ্ডের তালিকা
তৈরির কাজে অন্যতম পথপ্রদর্শক, সমরখন্দের সম্রাট ছিলেন ১৪৪৯ পর্যন্ত, তাঁর পর তাঁর
পুত্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং হত্যা করে।
No comments:
Post a Comment