দশম অধ্যায়
২। কারখানার জন্য আলাদা খাজাঞ্চিখানা
এখানে ভিন্ন এক ধরনের প্রাসাদি খাজাঞ্চিখানা(খাজিনা) সম্বন্ধে বলা দরকার, কেননা তাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে ভান্ডার এবং কারখানাগুলির পরিকাঠামো। আকবরের সভা-ঐতিহাসাহিক গর্বভরে বলছেন, -
‘ইরান এবং তুরানে মাত্র একজন খাঞ্জাঞ্চি নিযুক্ত হন এবং হিসাব-কিতাব বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকে; কিন্তু ভারতে রাজস্ব আদায়ের পরিমান এতই বেশি এবং ব্যবসার বিস্তৃতি আর ব্যাপকতা এত ব্যপ্ত যে, অর্থ রাখার জন্য ১২টি খাজাঞ্চিখানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে – ৯টা বিভিন্ন ধরণের নগদ অর্থ দেওয়ার জন্য, তিনটে বহুমূল্য পাথর, সোনা এবং পাথর খচিত অলঙ্কারের জন্য। ...উপঢৌকনের(পেশকাশ) জন্য আলাদা হিসাবরক্ষক, আর উত্তরাধিকারহীনদের সম্পত্তি দখল নেওয়ার জন্য বাইতুলমাল, নজর(সম্রাটকে ওজন করে নানান কিছু সম্পদ দিয়ে দানধ্যান করার জন্য দান) আদায়ের জন্য একটা’।
প্রধান এবং কেন্দ্রিয় খাজাঞ্চি(খাজিনাইআমারা) ছাড়া এখানে আমরা আটখানা খাজাঞ্চিখানার পদ এবং বিশদ বিবরণ পেলাম। মধ্য অষ্টাদশ শতে পারসিক ঐতিহাসিক শাকির খাঁ ১২টি খাজাঞ্চির নাম লিখে গিয়েছিলেনঃ-
১। আন্দারুণইমহল – হারেমের অভ্যন্তরের খাজাঞ্চিখানা। তাঁর জীবনের শেষদিকের সময়ে লেখা চিঠিতে বুঝতে পারি যে এটি মুঘল সম্রাটদের শেষতম অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
২। বকায়া – বিভিন্ন বাকি আদায় করার খাজাঞ্চিখানা।
৩। জেবইখাস – সম্রাটদের দৈনন্দিন খরচের খাজাঞ্চিখানা, যেসব দান তিনি নিজের হাতে করতেন।
৪। জেবইফয়েজ – ধার্মিক দানের জন্য খাঞ্জাঞ্চিখানা, যে অর্থ সম্রাট সারা বছর দানধ্যানের জন্য ব্যয় করেন, এ ছাড়াও তার ওজনের সোনা, রূপা এবং অন্যান্য বহুমূল্য জিনিসপত্র - গরীবদের এবং ধর্মীয় কাজে এবং ফকিরদের কাজে ব্যয় করার জন্য।
৫। খাজিনাইরিকাব – সম্রাটদের বিভিন্ন যাত্রার কাজে যে খাজাঞ্চিখানা ব্যবহার হয়।
৬/৭। খাজিনাইনজর ওয়া পেশকাশ – সম্রাটের ওপর চলতে থাকা গ্রহের ফের, অভিশাপ ইত্যাদি কাটানোর জন্য প্রজাদের দেওয়া নানান উপঢৌকন, উপহার, ইত্যাদি রাখার জন্য খাজাঞ্চিখানা। আবুল ফজল একে দুইভাগে ভাগ করেছেন, কিন্তু শাকির খাঁ(মধ্য অষ্টাদশ শতের) একে জুড়েছেন একটিতেই।
৮। খাজিনাইসার্ফইখাস – সম্রাটের ব্যক্তিগত খরচ(প্রিভি পার্স), তার নিজের পারিবারিক খরচের জন্য(এই অর্থ বাস্তবিক খরচ করতেন খানইসামান পদাধিকারী, সম্রাটের নিজের হাতে নয়)।
৯। বাইতুলমাল – উত্তরাধিকারী না রেখে যে সব কর্মচারী মারা গিয়েছেন, তাদের সম্পত্তি এখানে থাকত, ব্যয় হত ধর্মীয় কারণে, কোরানিয় আইনে সম্রাট এই এক কাণাকড়িও ছুঁতে পারতেন না।
আইনিআকবরিতে আরও তিনিটি খাজাঞ্চিখানার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে –
১০। বিভিন্ন বহুমূল্য পাথরের জন্য খাজাঞ্চিখানা
১১। সোনার তৈজসের জন্য খাজাঞ্চিখানা
১২। সোনা পাথর খচিত অলঙ্কারের জন্য খাজাঞ্চিখানা।
দুটি মারাঠি পুঁথি, সভাসদ ভাখর(১৬৯৪) এবং শিবাজীর চিটনিস ভাখর (১৮১০) বারোটি আলাদা নামের খাঞ্জাঞ্চির বর্ণনা দিচ্ছে, হয় সেগুলি ভাণ্ডার আর খাজাঞ্চির মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছে নয়ত মারাঠা আর মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে বেশ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, সেই চরিত্রগুলি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। এই পুঁথিগুলিতে উল্লিখিত খাজাঞ্চিখানার নাম হল, মড়া মহল বা কোষ – এঁদের ভাগ হল ফোতা, সোদাগরি, পালকি, কোঠি, ইমারত, পাগা, সেরি(বা সায়েরইবাগ), দারুণি, থাট্টি, টাঁকশাল, চ্ছাবিনা আর বাহিলি(বা জামদারখানা)।
এখানে পাগা যার মানে রিসালা মানে অশ্বারোহীদের, বাকায়া বা বাকি আদায়ের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে; বাহিলি যার মানে রাজার খরচ; চ্ছাবিনা হল পার্সি শাবিনার মারাঠি অপভ্রংশ – যার মানে রাজার সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়া অশ্বারোহী বাহিনী; একে আমি রিকাবের দূরতম অনুবাদ বলে মনে করি, যারা দূরে যাওয়া সম্রাটের সঙ্গে সঙ্গত করে। ফোতা সাধারণ নগদ খাজাঞ্চিখানা, দারুণি হল আন্দারুণি বা হারেমের খাজাঞ্চিখানা।
অন্যান্যগুলি কিন্তু ভাণ্ডার, কোনভাবেই খাজাঞ্চিখানা নয়। সায়েরইবাগ মানে ক্রীড়োদ্যানে ভ্রমণ, আমার মনে হয় না শুধু এই কাজের জন্য একটা আলাদা খাজাঞ্চিখানা বরাদ্দ থাকত। থাট্টি মানে পশুর দপ্তর(জুন্যা ঐতিহাসিক গোষ্ঠী)।
যাওয়াবিতইআলমগিরি ২৪টি খাজাঞ্চিখানার নাম করছে, যার একটা মূল খাজাঞ্চিখানা আর ওপরের তালিকায় পাঁচটির নাম দেওয়া হয়েছে কিন্তু ১৮টা আলাদা প্রকারের। এগুলি আশরফি(সোনার মুদ্রার), বেগমদের, জরিমানা, রসমহল(না রাসউলমাল?), দাম, আহদিস, শাগির্দপেশা(গায়েগতরে কাজ করা ভৃত্য), জায়গির বদল, তোপখানা, নথি দপ্তর, কুলারইহায়দারাবাদি, পশুর জন্য খাদ্য, উপহার, নগদ(মবলগ), হাতিখানার করণিকদের জন্য উপরি, সাধারণ খরচ(খরচইকুল), আর দুটি পড়া যাচ্ছেনা এমন নাম - হয়ত ঠিকা এবং মুতাফারকা(ইত্যাদি)র মত উপখাজঞ্চিখানা।
মিরাটইআহমদি থেকে জানাযায় সুবায় মাত্র চারটি খাজাঞ্চিখানা ছিল, ক) খাজিনাওইআমারা যার অন্য নাম বাইতইখারাজ, বা রাজস্ব, উপহার এবং হিন্দুদের পণ্যের ওপর কর ইত্যাদির খাজাঞ্চিখানা, খ) খানিনাইবাকায়া, বা তাকাভির বকেয়া, বা উপহার ইত্যাদির খাজাঞ্চিখানা, গ) খাজিনাইসাদকা আড়াই শতাংশ মুসলমানদের পর করের খাজাঞ্চিখানা(যাকাত আড়াই শতাংশ আবশ্যিক ভিক্ষা কর(আমস ট্যাক্স), কিন্তু সাদকা হল দানধ্যানের জন্য স্বেচ্ছা কর, পরের দিকে এই দুটিকে মিলিয়ে দেওয়া হয় – এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম) আর ঘ)খাজিনাইজাজিয়া যা হল অমুসলমানের জন্য মাথট বা মাথাপিছু করের খাজাঞ্চিখানা।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment